“হিস্ট্রি অফ কনটেম্পোরারি আর্কিটেকচার অফ বাংলাদেশ” / “History of Contemporary Architecture of Bangladesh”
কনটেম্পোরারি আর্কিটেকচার বা সমসাময়িক স্থাপত্যঃ
কনটেম্পোরারি আর্কিটেকচার বা সমসাময়িক স্থাপত্য বলতে মূলত বুঝানো হয় কোনো একটা নির্দিষ্ট যুগ বা সময়ের চাহিদা বা রুচি অনুযায়ী যে স্থাপত্যিক ডিজাইন করা হয়। সমসাময়িক স্থাপত্যে কোনো নির্দিষ্ট স্টাইলের ডিজাইন অনুসরণ করা হয় না।আর্কিটেক্ট বা স্থপতি গণ পোস্ট মর্ডানিজম, হাই–টেক আর্কিটেকচার ,ট্র্যাডিশনাল আর্কিটেকচার এর মত বিভিন্ন স্টাইলের ডিজাইন এর প্রয়োগ কনটেম্পোরারি আর্কিটেকচারে করে থাকেন।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন পৃথিবীর আধুনিক স্থাপত্য শিল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি স্থাপনা। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক স্থাপত্য রীতির স্থাপত্য সমূহের মধ্যে আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন এক অনন্য নিদর্শন। সময় যখন পাকিস্তান আমল, তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার ঢাকার শেরেবাংলা নগর কে দ্বিতীয় রাজধানী বানানোর এবং সেখানে দ্বিতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই ভাবনা থেকেই 1959 সালে প্রথম বর্তমান সংসদ ভবন কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯৬১ সালে বর্তমান মানিল মিয়া এভিনিউয়ের উত্তর পাশে ২০৮ একর জমি দ্বিতীয় রাজধানী প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়।১৯৬২ সালে ভবনটির মূল পরিকল্পনা পাশ হয় ।তৎকালীন সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সাহায্য চাইলে তিনি এই প্রকল্পে বিশ্বের নামিদামি স্থপতিদের নিতে চাইলেন। তিনি প্রথমে খ্যাতিমান স্থপতি আল্ভার আলটো এবং লি–কর্বুসিয়র কে প্রস্তাব দিলে তারা দুজনেই ব্যস্ত থাকায় পরে তিনি প্রস্তাব করেন আরেক বিখ্যাত স্থপতি লুইস আই ক্যান কে যিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে মাজহারুল ইসলামের শিক্ষক ছিলেন।
মার্কিন স্থপতি লুইস আই ক্যান রাজি হলে প্রথমে তাকে খসড়া নকশা করতে বলা হয় এবং পরবর্তীতে 1962 সালের মার্চ মাসে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। চূড়ান্ত নকশা প্রণীত হয় ১৯৬২ সালে এবং নির্মাণ শুরু হয় 1964 সালে। শুরুতে ভবনটি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় 15 মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা সমস্ত সুবিধা দেওয়ার শেষে ১৯৮২ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখন 32 মিলিয়ন মার্কিন ডলার এ গিয়ে ঠেকে। পুরো সংসদ ভবন এলাকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল মূল সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য মন্ত্রী ও সচিবদের হোস্টেল ,অতিথি ভবন এবং কমিউনিটি বিল্ডিং,রাস্তা্ , হাঁটার পথ , বাগান ও লেক ইত্যাদি। প্রাথমিক নকশায় সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও মসজিদ অন্তর্ভুক্ত না থাকলে ও এক্ষেত্রে মূল ভবনের আকর্ষণ যাতে না কমে যায় সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। এতে এসব ভবন কে সরিয়ে সংসদ ভবন থেকে সরিয়ে দূরে নির্মাণ করার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়।
১৯৬৪ সালে প্রধান ভবনের কাজ শুরু হলেও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্মাণাধীন অবকাঠামোর কাজ পুরোপুরি বন্ধ থাকে । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্ত নকশায় কোনো রকম পরিবর্তন না এনে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সংসদের 354 আসনবিশিষ্ট অ্যাসেম্বলি কক্ষ জাতীয় সংসদ।
ভবনের স্থপতি লুইস আই ক্যান সূর্যের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চেয়েছেন । তা ছাড়া বৃষ্টির প্রতি যথেষ্ঠ মনোযোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে ভবনের বাইরের দিকে জ্যামিতক ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র , সমতল বৃত্তাংশ আর সম্পূর্ণ বৃত্তাকার খিলান সমূহ ভবনের ভেতর বাতাসের চলাচলকে করেছে বাধাহীন । স্থাপত্যশৈলীতে ভবনটি আধুনিক স্থাপত্য ধারার অনন্য নজির হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ভবন নির্মাণ কোথাও কলামের ব্যবহার হয়নি। বিশাল স্থাপত্যের অসুবিধা দূর করতে ভবনটিতে বিশাল বিশাল ব্যবহার ফাঁক ব্যবহার করা হয়েছে। তবে নকশার কাঠামো ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে শূন্যস্থানে কোথাও কোথাও ফাপা কলাম বসানো হয়েছে । প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার কিভাবে পুরো ভবনটি আলোকিত করা যায় তা ছিল লুই কানের নকশার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ । মূল ভবনটি নয়টি প্রধান ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে এর মধ্যে ৮ টি ৩৩.৫৩ মিটার উঁচু এবং কেন্দ্রীয় অষ্টাভুজাকৃতির ব্লকটি ৪৭.২৪ মিটার উচু যা ৩৫৪ টি আসন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাসেম্বলি কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমগ্র কমপ্লেক্সের মধ্যে মূ;ল ভবনের আয়তন ৭৪,৪৫৯.২০ বর্গমিটার।দক্ষিন প্লাজায় ২০,৭১৭.৩৮ বর্গমিটার এবং উত্তর প্লাজার আয়তন ৬,০৩৮.৭ বর্গমিটার।
সসদ ভবন বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের প্রতীক, আস্থার প্রতীক। সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটি সবুজের সমারোহ সজ্জিত। এতে তৈরি করা হয়েছে মনমুগ্ধকর সবুজ ঘাসের বাগান, পাশাপাশি লোকের মাধ্যমে ভবনটিকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে যেন মনে হয় পুরো ভবনটি পানির উপর ভেসে আছে। চার পাশে আছে ইউক্যালিপটাস আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। কমপ্লেক্স এলাকার মধ্যে আছে একটি অ্যাম্পিথিয়েটার যেখানে জাতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তাছাড়া আছে হোস্টেল, আবাসিক ভবন ও রাস্তা। 50 টি সোপান, 340 টির শৌচাগার 1653 দরজা এবং 335 জানালা নিয়ে ভবনটি গঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সমসাময়িক পত্র–পত্রিকায় বাংলাদেশের সংসদ ভবনের স্থাপত্য–শৈলীর প্রশংসা করা হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী হতে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক স্থাপত্যকলার তালিকায় রয়েছে লুইস আই ক্যান এর নকশায় গড়ে ওঠা এই ভবনটি যারা দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে । আমাদের গর্বের বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন তার স্বাতন্ত্র্য স্থাপত্যশৈলী গত বৈশিষ্ট্যের জন্য আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়। 1982 সালের 28 জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আব্দুস সাত্তার জাতীয় সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন । সেই বছরই 15 ফেব্রুয়ারি নতুন গড়ে ওঠা এই ভবনে প্রথমবারের মতো সংসদের অধিবেশন বসে । সমসাময়িক স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত ,বাংলাদেশের সংসদ ভবন। লুইস আই ক্যান এর সর্বশেষ কাজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেরেবাংলানগরে । বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠা এই সংসদ ভবন একইসাথে বাংলাদেশের মানুষের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও গর্ব ।
লেখক
লিমা আক্তার
জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর
আর্কিটেকচার এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন টেকনোলজি
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট