নিয়ান্ডারথাল : হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আদ্যোপান্ত

নিয়ান্ডারথাল : হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আদ্যোপান্ত

চারপাশের কয়েক প্রজাতির সাপ দেখা যায়। ব্যাঙের বেশ কয়েকটি প্রজাতি আমাদের চোখে পড়ে।প্রাণী জগতের সকল প্রাণীরই রয়েছে আলাদা আলাদা প্রজাতি। আমরা মানুষরাও কিন্তু এক প্রজাতির নই। মানুষেরও বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে।তবে বিবর্তনের পথ হেঁটে অন্য সকল প্রজাতিকে টেক্কা দিয়ে আজকে আমরা আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি। টিকে রয়েছি কয়েক হাজার বছর ধরে।মানুষের প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল।তারা আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের অসংখ্য ফসিল উদ্ধার করা গেছে বর্তমান সময়ে এসে। ফলে অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে নিয়ান্ডারথাল সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি বেশি।আজকের লেখায় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল মানুষ প্রজাতির সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

      ল্যাটিন শব্দ Homo এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Human বাংলায় মানুষ। যদিও ১৮৫৬ সালের আগেই নিয়ান্ডারথালদের বেশ কয়েকটি ফসল আবিষ্কৃত হয়েছিল; তবুও ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকা থেকে পাওয়া ফসিলটি ছিল নিয়ান্ডারথালদের আদর্শ নমুনা বা ফসিল। এই নিয়ান্ডার উপত্যকার নামানুসারে মানুষের এই প্রজাতির নামকরণ করা হয় নিয়ান্ডারথাল।

                                                  জার্মানির    নিয়ান্ডার ভ্যালি

     ১৮২৯ সালে বেলজিয়ামের এঞ্জিসের‘ কাছাকাছি গুহা থেকে একটি নিয়ান্ডার্থাল শিশুর মাথার খুলি আবিষ্কার করা   হয়।  নিয়ান্ডারথালদের পাওয়া ফসিলগুলোর মধ্যে এটি ছিল প্রথম  ফসিল। তবে ১৯  শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরও ফসিল আবিষ্কার না হওয়া অবদি এটি সম্ভাব্য মানব পূর্বপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। তারপর থেকে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ফসিল পাওয়া যায় ।এর মধ্যে বাচ্চা, শিশু এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কের ফসিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।যার ফলে অন্য যেকোনো মানব পূর্বপুরুষের চেয়ে নিয়ান্ডারথাল সম্পর্কে বেশি জানা যায় । ফ্রান্সের লে মুস্টিয়ে থেকে ৪৫ হাজার বছর আগের একটি মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয় । এটি ছিল কৈশোরে উপনীত এক নিয়ান্ডারথালের খুলি। নিয়ান্ডারথালদের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা এই খুলির মধ্যেও ছিল।এরপর একের পর এক ফসিল আবিষ্কার হতে থাকে। ১৯০৯ সালে ফ্রান্স থেকে ১৯৮৩ সালের ইসরাইল থেকে।এই ফসিলগুলো নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানে সাহায্য করে গবেষকদের।

 

        নিয়ান্ডারথালদের বিকাশ ঘটেছিল ইউরোপ এবং এশিয়াতে ।পক্ষান্তরে বর্তমান মানুষের প্রজাতির বিকাশ ঘটতে থাকে আফ্রিকাতে। ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখেছেন যে , নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চার লক্ষ বছর আগে ইউরোপে । এই প্রজাতিটি ইউরেশিয়া , পশ্চিম পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে সাইবেরিয়ার আলটাই পর্বতমালা পর্যন্ত  বিস্তৃত ।নিয়ান্ডারথালরা ছিল অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন।ঠান্ডা জলবায়ু সত্বেও কয়েক লাখ বছর ধরে সফল ভাবে বসবাস করেছিল তারা। 

         নিয়ান্ডারথালদের মাথার খুলির ছিল লম্বা এবং নিচু ।আধুনিক মানুষের মত গোলাকৃতি ছিল না। তাদের চোখের ওপর আলাদা বিশেষ ধনুকাকৃতির ভ্রু ছিল। তাদের মুখের কেন্দ্রীয় অংশটি সামনের দিকে একটু বেশি প্রসারিত ছিল।তাদের চেহারার মধ্যে যে বিষয়টি সহজে ধরা পড়তো সেটি হচ্ছে লম্বা এবং প্রশস্ত নাক। কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তাদের এ ধরনের চেহারা হবার কারণ ছিল ঠান্ডা এবং শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য। তাদের নাক অপেক্ষাকৃত বড় ছিলো, কারণ সেগুলো তারা যে নিশ্বাস নিতো তা আদ্র এবং উষ্ণ করতে কাজে লাগাতো। তাদের সামনের দাঁত অনেক বড় ছিল এবং তাতে ছিল নানা দাগের চিহ্ন।তারা যখন খাবার বা অন্যান্য উপকরণ তৈরি করত তখন তাদের লম্বা দাঁতগুলো তৃতীয় হাতের কাজ করতো। নিয়ান্ডারথালদের শক্ত পেশীবহুল দেহ ছিল। কোমর এবং ঘাড় ছিল প্রশস্ত। পূর্ণবয়স্ক নিয়ান্ডারথালরা ১.৫০ থেকে ১.৭৫ মিটার লম্বা হতো এবং ওজন হতো ৬৪-৮২ কেজি। প্রথমদিকে নিয়ান্ডারথালরা     শেষের দিকে বিলুপ্ত হওয়া নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে লম্বায় আরো বড় ছিল, তবে ওজন একই ছিল।নিয়ান্ডারথাল নারীদের স্তনের আকার অনেক বড় ছিল। কারণ দ্রুত মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রচুর মাতৃদুগ্ধ প্রয়োজন হতো। ছোট হাত এবং পা নিয়ে তাদের শরীর ছিল গাট্টাগোট্টা ধরনের।এ ধরনের শরীর ঠাণ্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত ছিল।

    নিয়ান্ডারথালরা গুহায় বসবাস করলেও তাদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ছিল এবং তাদের আচরণ ছিল অনেকটাই মার্জিত। তাদের ব্রেইনের আকার ছিল ১২০০ থেকে ১৭৫০ ঘন সেন্টিমিটার। যা বর্তমান মানুষের তুলনায় বেশি। নিয়ান্ডারথালরা তাদের বুদ্ধি দিয়ে বিভিন্ন অস্ত্র ,যেমন – বর্শা, কুড়াল বানাতে পারত ।তিন লক্ষ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা লিভালইস টেকনিক নামক পাথুরে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে ।

   নিজ প্রজাতির মাংস খাওয়াকে ক্যানিবালিজম বলে। এক সময় নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও ক্যানিবালিজম এর চর্চা ছিল।সম্প্রতি আমেরিকার ক্যালিফোনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী হেলেন রুশিয়ের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক টিম গোয়েত গুহা থেকে প্রাপ্ত নিয়ান্ডার্থালদের হার নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন। তাদের গবেষণায়ও নরভক্ষণের  প্রমাণ মিলেছে। তারা ঠিক কি কারণে নিজেদের মাংস খেত সেটা এখনও রহস্যের বিষয়।

        নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষও ছিল একই। সরাসরি পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস হয়ে হোমো অস্ট্রালোপিথ্যাকাস্‌দের থেকে বিবর্তিত হয়েছি আমরা উভয়েই।  জেনেটিক গবেষণাও প্রমাণ করে, অস্তিত্বের প্রথম ১ লাখ বছর ধরে আমাদের ডিএনএ’র কিছু অংশও সাধারণ পূর্বপুরুষদের থেকে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে ভাগ করে পেয়েছি আমরা।তাই নিয়ান্ডারথালদের আদিম প্রজাতি হিসেবে না নিয়ে সহাবস্থান শুরু করে আধুনিক মানুষেরা। তারপর কিছু পরিবর্তন ঘটে। আমাদের অস্ত্রের সঙ্গে প্রতীকী শিল্পকর্ম উন্নত হতে শুরু করে। ফলে হোমিও স্যাপিয়েন্সরা জটিল করে তোলে নিয়ান্ডারথালদের জীবনযাত্রা।                   

   জার্মানির জাঁ জ্যাক লিপজিগ বিবর্তনমূলক নৃ-বিজ্ঞান ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের হাবলিন বলেন, হোমো স্যাপিয়েন্সরা তাদের বাসস্থান দখলে নিয়ে নিলে নিয়ান্ডারথালরা খুব শিগগিরই বাস্তুচ্যুত হয়। ফলে আধুনিক মানুষের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তারা।

জার্মানির টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোলাস কোনার্ডের দল নিয়ান্ডারথালদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইউরোপে আধুনিক মানুষের স্থল আঘাত তাদের জনসংখ্যাকে দ্রুত কমিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে আমাদের সংখ্যা বেড়ে যায়, আমরা আরো অনেক জটিল সামাজিক ইউনিটে বসবাস শুরু করি এবং প্রয়োজন অনুসারে আরো পরিশীলিত উপায়ে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। ফলে আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হলে ইউরোপ- আফ্রিকা তথা পুরো পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে বাধ্য হয় তারা’।  

 

সূত্র : গুগল 

শাহনেওয়াজ সেরাজ সুবর্ণা

ইন্সট্রাক্টর অফ আর এস ডিপার্টমেন্ট

ডেফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

 

Tags: No tags

Comments are closed.