রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাণ্ট আর্শীবাদ নাকি অভিশাপ
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি নিউক্লিয়াস কে ভাঙতে ভাঙতে উৎপন্ন শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা ।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতই এক ধরনের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেখানে নিউক্লিয়াস কে ভাঙার ফলে উৎপন্ন শক্তি দিয়ে তাপবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। কিন্তু অবশ্যই সেটি নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যে হতে হবে নতুবা বিপদ ঘটে যেতে সময় লাগবে নাহ।
বর্তমানে ৩১টি দেশে ৪৫০ টিরও বেশী নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট সচল রয়েছে, বাংলাদেশ ও তার মধ্যে একটি, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে এই অভিজাত ক্লাব এ পদার্পন করতে যাচ্ছে।
পাবনার ঈশ্বরদীর রুপপুরে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে যা পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত, এবং ঢাকা থেকে ১৮৭ কিমি পশ্চিমে।
সেই ১৯৬১ সালের প্রস্তাবনার পরে, অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে ২০১৬ সালে কাজ শুরু হয়, আশা করা হচ্ছে ২০২৩ সালে এক ইউনিট ও অপর ইউনিট ২০২৪ সাল নাগাদ উৎপাদনে যাবে, তখন এটিই হবে দেশের সর্বাধিক মেগাওয়াট সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় ২৪০০ মেগাওয়াট (২*১২০০মেগাওয়াট)
একনজরে কিছু কুইক ফ্যাক্টস দেখে নেয়া যাকঃ
নির্মাতাঃ রাশিয়ার রোসাটম
মালিকানাঃ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
রিয়াক্টর টাইপঃ প্রেসারাইজড ওয়াটার(PWR)
রিয়াক্টর মডেলঃ VVER-1200 (সাম্প্রতিক মডেল)
শীতলীকরণ উৎসঃ পদ্মা নদী
ইউনিটঃ ২
প্রক্কলিত ব্যয়ঃ প্রায় ১২.৬৫বিলিয়ন ডলার , বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ( ১,০৬২,৩৯৭,৬০০,০০০.০০) টাকা
ফুয়েল সাপ্লাইয়ারঃ রোসাট্ম এনার্জি
উপাদানঃ ইউরেনিয়াম ২৩৫
নিরাপত্তা স্তরঃ ৫ ধাপের
আয়ুষ্কালঃ ৬০ বছর
কন্ট্রাক্টরঃ JSC Atomstroyexport
একবার ফুয়েল লোডেঃ ৪–৫ বছর সাপ্লাই দিবে
অনেক হল , এবার কাজের কথায় আশা যাক।
আসলেই কি বাংলাদেশ পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছেঃ
পরিবেশ গত দিক দিয়ে সেটা এখনো অর্জন করেনি,এছাড়াও দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে, রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাণ্ট চালাতে বিদেশিদের উপর পূর্নাঙ্গ ভাবে নির্ভরশীল।
তবে কিছু সংখ্যক উত্তীর্ণ প্রার্থীকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে প্রশিক্ষণ এর জন্য, তারা ফিরে এসে এটি পরিচালনায় সাহায্য করবেন।
নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন মানব সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ, বিশেষকরে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে আরও বিপদজনক, এটি অনেকটা গরীবের হাতি পোষার সামিল।
পরিবেশবাদীরা ধারণা করেছেন, (কথাটি সরাসরি বলা হয়নি,কিন্তু ধারণা করা হয়েছে পূর্বের ঘটনা থেকে),
রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাণ্ট এর আশেপাশের এলাকার মাটিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া যাবে যা কিনা এই এলাকার উর্বরাশক্তি বিনাশ করে দিবে, সাথে পদ্মার পানিতে যদি কোনক্রমে মিশে যায় তাহলে যা ঘটবে তা সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ হবে, বায়ুতে তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাত্রা বেড়ে গিয়ে অক্সিজেনের সাথে মিশে সেই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষতির মুখে ফেলে দিবে, ফলাফলঃ ক্যান্সার,শ্বাসকষ্ট সহ আরও অনেক রোগের বিস্তার কতিপয় এলাকায় বেড়ে যাবে,সন্তান পঙ্গু হয়ে জন্ম হবার মাত্রা বেড়ে যাবে,মানুষের সহনশীলতার মাত্রার হ্রাস ঘটবে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে, ওই এলাকার মাটিতে ফসল ফলানো দিনের পর দিন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে , আবার ফসলে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বেড়ে গেলে সেই ফসল ভক্ষণ যোগ্য থাকবে নাহ।
যারা এখানে জব করবে, তাদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ভাতা বরাদ্দ করা থাকবে, তার মানে বুঝাই যায় অনেকটা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই জব করতে হবে।
যতই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হোক না কেন, ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আরেকটি চেরনোবিল বা ফুকিশিমার মত দূর্ঘটনার জন্মস্থান বাংলাদেশ হতে পারে। যদিওবা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে একে ঘিরে।
এত উচ্চ মাত্রার শক্তিশালী বিক্রিয়ার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারালে রেডিয়েশন ছড়িয়ে পরে জীবনযাত্রা স্থবির করে দিবে।
তবে আশার কথা হল , এই রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাণ্ট প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে যেমন সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে , ন্যাশনাল গ্রিড এর সক্ষমতা বাড়বে,তেমন দেশব্যাপী লোডশেডিং হ্রাস পাবে, সর্বোপরি দেশের জিডিপির মান বাড়বে ,আশেপাশের এলাকায় নতুন কর্মসংস্থান এর সৃষ্টি হবে, জীবনযাত্রার মান বাড়বে, দেশের বিদেশী বিনিয়োগ আসবে প্রচুর পরিমাণে।
তবে, প্রযুক্তি বাছাই এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণের পর পারমাণবিক নিরাপত্তার বৈশিষ্ট্যসমূহও কাস্টমাইজ করার স্বাধীনতা বাংলাদেশের রয়েছে । অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার রূপপুরে ভিভিইআর পরিবারের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি(VVER-1200 ) নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
উক্ত প্রযুক্তিতে রাশিয়ান ফেডারেশন কর্তৃক উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক যেকোনো পারমাণবিক নিরাপত্তামূলক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে যথাযথ উপায়ে ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন থেকে শুরু করে রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি দেশের দীর্ঘ মেয়াদী জাতীয় সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন।
রূপপুরে নির্মিতব্য রিয়াক্টর-এর নিম্নবর্ণিত (ছবি) পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে।
নিচে রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যাণ্টঃ পরিকল্পনা দেখানো হয়েছেঃ
Unit 1 Unit 2
First Concrete 30 November 2017 14 July
2018
Fuel Loading October 2022 October 2023
Power Start-up December 2022 December 2023
Provisional Takeover October 2023 October 2024
Final Takeover October 2024 October 2025
সেরা ৫ : সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন ৫টি পারমাণবিক চুল্লী
পারমাণবিক যুগে আমাদের বসবাস। পেট্রোলিয়াম আর গ্যাসোলিন ফুরিয়ে গেলে মানবসভ্যতা পুরোপুরি সৌরশক্তি, হাইড্রোজেন সেল এবং নিউক্লিয়ার এনার্জির উপর নির্ভর হয়ে পরবে। বর্তমানেও পারমাণবিক চুল্লীর সংখ্যা কম নয় কিন্তু। উন্নয়নশীল এবং উন্নত-দেশগুলো তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করছে পারমানবিক চুল্লী। একসময় এই শক্তির সিংহভাগ উৎপন্ন করা হতো জাপানের ফুকোশিমাতে। কিন্তু ২০১১ এর ভূমিকম্প পুরোপুরি অচল করে দেয় পাওয়ার স্টেশনকে। কিন্তু এতো বাধার পরও গড়ে উঠছে আরো শক্তিশালী পারমাণবিক চুল্লী। power-technology.com এর লিস্ট অনুযায়ী আজকে থাকছে পৃথিবীর সেরা ৫ টি পারমানবিক চুল্লী।
Tokyo Electric Power Co.’s (TEPCO) এর তৈরি করা এই চুল্লীর মোট ক্ষমতা ৭৯৬৫ মেগাওয়াট। এই চুল্লীতে রয়েছে ৭টি বয়েলিং ওয়াটার রিয়েক্টর। যাদের ক্ষমতা প্রায় ৮২১২ মেগাওয়াট। প্রথম ৫ টির প্রত্যেকটির ক্ষমতা ১১০০ মেগাওয়াট আর বাকি দুইটার ক্ষমতা ১৩৫৬ মেগাওয়াট। ১৯৮৫ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে সাপ্লাই দেওয়া হয়। বিভিন্ন আপডেট এর মাধ্যমে ২০১৩ সালে এর মোট ক্ষমতা হয়ে দাঁড়ায় ৭৯৬৫ মেগাওয়াট।
২। Bruce Nuclear Generating Station
কানাডায় অবস্থিত এর পারমাণবিক চুল্লী বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ক্ষমতার দিক থেকে। মোট ক্ষমতা ৬২৩৪ মেগাওয়াট এবং চুল্লী Bruce Power এর নিয়ন্ত্রণে আছে।
বয়েলিং ওয়াটার রিয়েক্টর এর পরিবর্তে রয়েছে প্রেসারাইজড হেভি ওয়াটার রিয়েক্টর (PHWR) এবং এটি সংখ্যায় ৮টি। প্রত্যেকটি PHWR ৭৮৬ থেকে ৮৯১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন। পুরো চুল্লীটি দুইটি অংশে বিভক্ত। Bruce 1 এবং Bruce 2. ১৯৮৭ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা হলেও ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এর সকল Bruce 1 এর কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
৩। Hanul Nuclear Power Plant
প্রথমে নাম ছিলো Ulchin, পরবর্তীতে কিছু পরিবর্তন এনে ২০১৩সালে নতুন করে নাম দেওয়া হয় Hanul Nuclear Power Plant. ৬১৮৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এই চুল্লী থেকে গড় ক্ষমতা পাওয়া যায় প্রায় ৫৯০৮ মেগাওয়াট। প্রাথমিক অবস্থায় এটা শুরু করা হয় ৬ টি প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টর দিয়ে। পরবর্তীতে আরো ২টি রিয়েক্টর যুক্ত করা হয়। নতুন রিয়েক্টর গুলো এখনো কার্যকর করা হয় নি। এ বছরের মধ্যেই চালু করা হবে। মোট ৮ টি রিয়েক্টর চললে এই বছরে এর ক্ষমতা দাঁড়াবে ৮৬০৮ মেগাওয়াট। যা এই বছরের শেষে দখল করবে প্রথমস্থান।
৪। Hanbit Nuclear Power Plant
৬১৬৪ মেগাওয়াট ক্ষমতা বিশিষ্ট এই পারমাণবিক চুল্লী অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ায়। স্থানীয় ভাষায় Yeonggwang Nuclear Power নামে পরিচিত। ৬টি প্রেশারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টর দিয়ে তৈরি হলেও ২০১২ সালে এর ৩ টির মধ্যেই চির ধরা পরে। তখন কেবল বাকি তিনটি রিয়েক্টর কার্যকর ছিলো। কেবল ৮ মাস সময়ের মধ্যেই Korea Hydro & Nuclear Power (KHNP) ৩টি রিয়েক্টরকে কার্যকর করে তোলে।
৫। Zaporizhzhia Nuclear Power Plant
গণনায় ৫ম এই চুল্লী ইউক্রেনে অবস্থিত। ৬০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও এর থেকে উৎপাদন করা হয় ৫৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যেও রয়েছে ৬টি VVER-1000 প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টর।
গণনার বাইরে Fukushima Daini Nuclear Power Plant নিয়ে বলতে গেলে, এটি হলো ১০ম বৃহত্তর নিউক্লিয়ার চুল্লি। জাপানে অবস্থিত এই চুল্লী ২০১১ সালে বিধ্বস্ত হয়। সুনামির ফলে তৈরি হওয়া ৯ মেগনিটিউডের ভূকম্পন ৩টি রিয়েক্টরকে সাথে সাথে ধ্বংস করে দেয়। এর ক্ষমতা ছিলো ৪২৬৮ মেগাওয়াট।
লেখকঃ
মোঃ আব্দুল্লা-আল-মামুন রুপম
ইন্সট্রাকটর, ইলেকট্রিক্যাল