বর্তমানে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপকরণ ‘ইট’। বাংলাদেশ সরকার ইটকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, তা হলো ‘ইট’ অর্থ বালু, মাটি বা অন্য কোনো উপকরণ দ্বারা ইটভাটায় পুড়িয়ে প্রস্তুতকৃত কোনো নির্মাণসামগ্রী। সংজ্ঞাটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথমত, বালু পুড়িয়ে ইট তৈরি করা যায় না। দ্বিতীয়ত, মাটি ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ পুড়িয়েও ইট তৈরি করা যায় না। তৃতীয়ত, ইট মানেই ইটভাটায় পুড়িয়ে প্রস্তুত করা নির্মাণসামগ্রী। এবার আসি ইট তৈরির মাটি প্রসঙ্গে। আইনে যেভাবে বলা আছে তা হলো, ‘জেলা প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে মজাপুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটিতে বা সংগ্রহ করিতে পারিবেন।’ আমার জানামতে, যে মাটি কৃষিকাজের জন্য উপযোগী, কেবল সেই মাটিই ইট প্রস্তুতের জন্য উপযোগী, মজাপুকুর বা খাল বা বিলের মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত জৈব পদার্থের উপস্থিতির কারণে ভালো মানের ইট তৈরি সম্ভব নয়।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিবছর শতকরা এক ভাগ কৃষিজমি হারাচ্ছে, যার দ্বিতীয় প্রধান কারণ, ইটের কাঁচামাল ও ইটের ভাটা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ মাত্র ১২ শতাংশ। যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আমাদের চেয়ে তিন গুণ ও গণচীনে দুই গুণ বেশি। তারপরও চীন ও ভারতে ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কোনো দেশে পরিবেশগত কারণে কমবেশি ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক। এমতাবস্থায় বনজ কাঠ ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকলে বনাঞ্চল আরও সীমিত হবে, যা কাম্য নয়। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমবেশি দুই হাজার পাঁচ শ কোটি ইট তৈরি হচ্ছে। এই ইট তৈরিতে ১৮ হাজার হেক্টর (১৮০ বর্গকিলোমিটার) কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, প্রায় ৮০ লাখ টন কাঠ ও কয়লা পুড়ছে, যা থেকে পরিবেশে আনুমানিক ২ কোটি টন কার্বন নির্গত হচ্ছে।
উপরিউক্ত বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে পোড়ামাটির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের বিকল্প নির্মাণসামগ্রী গ্রহণ করতে হবে। যেটা হবে সার্বিকভাবে কৃষিবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগসহনীয়, লাগসই, টেকসই, সর্বোপরি ব্যয়সাশ্রয়ী। ইটের বিকল্প নির্মাণ উপকরণ হিসেবে উল্লিখিত গুণাবলিসম্পন্ন একাধিক নির্মাণ উপকরণ ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ব্যবহার সন্তোষজনক পাওয়া যায়। নিচে পরিবেশ বান্ধব উপকরণের বিশদ বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো।
কংক্রিট ব্লক: সিমেন্ট, বালু ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ৪ মিমি পাথরের কণা বা ডাস্ট সমন্বয়ে এই ব্লক তৈরি করা হয়। ম্যানুয়েল, মেকানিক্যাল বা হাইড্রোলিক মেশিন ব্যবহার করে এ ব্লক তৈরি করা যায়। এই ব্লকের ব্যবহারের ক্ষেত্র বিবেচনায় প্রশস্ত পরিসরে বিভিন্ন গুণাগুণের সামগ্রী তৈরি করা যায়। এটা কারখানায় যেমন অতি বড় আকারে প্রস্তুত করা যায়, আবার ছোট আকারে নির্মাণ সাইটেও তৈরি করা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজাইনমাফিক বিভিন্ন মান ও দামের ব্লক তৈরি করা যায়। কংক্রিট ব্লক হলো (hollow) সলিড (solid) ইন্টারলকিং (interlocking) বা থার্মাল (thermal) যেকোনো রকমের হতে পারে। আবার ইচ্ছেমতো যেকোনো রঙের করাও সম্ভব। বর্তমানে ইট ব্যবহারে যেমন ভার বহনকারী ও পার্টিশন ওয়ালের জন্য একই শক্তির ইট ব্যবহার করা হয়, ব্লকের ক্ষেত্রে সেটার প্রয়োজন হয় না। ফলে ব্যয়সাশ্রয়ী হয়। হলো ব্লকের ওজন কম, আকার–আকৃতি ভালো। ফলে অধিকতর ভূমিকম্পসহনীয় এবং গাঁথুনি ও প্লাস্টারে (যদি লাগে) খরচ কম। তা ছাড়া প্রচলিত ইটের সমতুল্য কংক্রিট ব্লক মূল্যসাশ্রয়ী (২৫% কম) হওয়ার কারণে অধিকতর তাপ কুপরিবাহী। ফলে গরম ও শীতে ঘর আরামদায়ক ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হয়। ব্লকের ওজন কম ও সাইজে বড় হওয়ায় কম জনবল দিয়ে অতি দ্রুত সময়ে কাজ করা যায়। লবণাক্ততা না থাকার কারণে দেয়ালের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নেই বললেই চলে। কার্বন নিঃসরণ প্রচলিত ইটের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ।
হলো ব্লক ব্যবহারে দেয়ালের খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ কম হয়। থার্মাল ব্লকে বাইরের অংশে হলো ব্লকের মতো কংক্রিট থাকে এবং ভেতরের অংশ ফাঁকা না রেখে ইপিএস দিয়ে ভরাট করা হয়। ফলে হালকা ও অধিকতর তাপনিরোধক হয়ে থাকে, যা ঘরকে আরামদায়ক, রক্ষণাবেক্ষণমুক্ত ও ভবনকে ভূমিকম্প সহনীয় করে।
সুবিধা সমূহ:-
- শব্দ, অগ্নি ও তাপ নিরোধক।
- ইলেকট্রিক্যাল পাইপ বসানোর জন্য দেয়াল কাটা লাগে না।
- ইটের ন্যায় অধিক পানি শোষণ করে না।
- এই ব্লক গাঁথুনীর কাজে ব্যবহারের আগে ইটের মতো পানিতে ভেজাতে হয় না।
- কনক্রীটের ব্লকে নোনা ধরে না, ঘামে না, ড্যাম্প হয় না, ফাঁঙ্গাস পড়ে না বলে এটি দীর্ঘস্থায়ী।
- কনক্রীটের ব্লকে ইটের তুলনায় কম পুরুত্বের প্লাস্টারিং ব্যবহার করা হয়।
- বাড়ির ব্যক্তিগত ওজন ও নির্মাণ খরচ দুই-ই কমাবে।
- পরিবেশবান্ধব এবং ভূমিকম্প সহনশীল।
- কৃষি জমি ও বনজ সম্পদরে অপচয় রোধ।কোন জ্বালানীর প্রয়োজন হয় না।পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে না। সারা বছর ব্যাপী উৎপাদন করা সম্ভব।শব্দ শোষন ক্ষমতা বেশিঅগ্নি ও তাপ নিরোদক অধকি র্কাযক্ষম।স্থায়ত্বিকাল ও কাঠামোগত ভারসাম্য বেশ ভাল।
লেখক,
মোঃ মাহবুবুর রহমান
ইন্সট্রাক্টর,
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট