চন্দ্র চুরি !
ঝিম ধরা মাথাটা আর কাজ করতে চাচ্ছেনা। যেকোন মুহুর্তে আন্দোলন করে বলতেই পারে WE WANT JUSTICE!!! আর বলবেই বা না কেন? কাজের সুবাদে অধিকাংশ সময় তাকিয়ে থাকতে হয় ওই এক গণনাকারি যন্ত্রের দিকে। জি না, আমি কোন একাউন্টেন্ট নই। আমি একজন সদ্য পাশ করা আর সদ্য নতুন কর্ম জীবনে প্রবেশ করা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কর্ম জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুরিটি পূর্ণ করতেই দেশের অন্যতম সুনাম ধন্য এক পলিটেকনিক এ শিক্ষকতায় প্রবেশ করেছি। নতুন নতুন চাকুরি বলে কথা। তাই আগ্রহ আর কর্ম উদ্দীপনা একটু বেশি তাই অফিস টাইমের পরে অগ্রিম কিছু কাজ করে রাখি। যাইহোক, কাজের চাপে চোখ বুজে যাচ্ছিলো যখন তখন মস্তিষ্ককে বুঝাতে থাকলাম এখন আন্দলন না করে সুবোধের মত কাজ করো তখনই কেন জানি মস্তিষ্ক আমাকে ফিস ফিস করে বলে উঠলো “ ওগো চলোনা গো একটু ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখি” । ব্যাস হয়ে গেলো, মনের ডাকে দেহ সারা দিয়ে উঠলো। চেয়ার ছেরে উঠে মুখে পানির ঝাপটা মেরে চলে গেলাম ছাদে চন্দ্র বিলাস করতে।
ছাদে গিয়ে একটু হতাশ। আরে চাঁদ টা যে আকাশে নেই! চাঁদ ছাড়া আকাশ টা কেমন জানি আলুর বোখারা ছাড়া কাচ্চির মত লাগছে। যাইহোক তবুও মনটাকে সতেজ করতে রেলিং এর উপর দুহাত রেখে দৃষ্টি ছুরে দিলাম আকাশের দিকে। একটা দুর্বিন থাকলে ভালো হতো। আসলেই কি আজ চাঁদ উঠেনি আকাশে? মন্দ লাগছেনা আকাশটাকে। কোটি তারার আলোয় রাতের আকাশ টা কেমন যেন বিয়ে বাড়ির মত ঝিকিমিকি করছে। চাঁদ মামার কি তবে আজ বিয়ে ? হা হা হা। নাহ সেতো ছোট বেলার কল্প কাহিনী।
আমার বাদর গোছের ছোট ভাই এলো হাতে দু মগ চা নিয়ে। ও অবশ্য নিয়মিত যাত্রী এই ছাদের। আজ হয়তো আমাকে আসতে দেখে চা সহ এসেছে। এসেই বললো “কিরে ভূতে বা পরীতে ধরেনিতো যে আজ হঠাৎ ছাদে ?” বললাম, “ নাহ তেমন কিছুনা। এক ঘেয়ে জীবনে একটু চন্দ্র বিলাসে আসলাম আর কি।“ ছোট ভাই বললো “ হুম নে নে চন্দ্র বিলাস কর। কিন্তু তোর চন্দ্র তো মনে হয় চুরি হয়ে গিয়েছে। কোথাও তো নাই।“ বলেই হাসতে হাসতে ছাদের অপর প্রান্তে গিয়ে কি যেন একটা গান গাইতে থাকলো। সে যাই হোক চায়ে চুমুক দিয়েই কেন জানি প্রশ্ন হলো আসলেই তো যদি চাঁদ টা কখনো এলিয়েন দ্বারা চুরি হয়ে যায় কিংবা মহাকর্ষিক কোন কারনে চাঁদ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় বহু দূরে তাহলে কি হবে আমাদের অর্থাৎ এই সুন্দর পৃথিবীর?
প্রায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমাদের এই এক মাত্র উপগ্রহটি। পৃথিবী জন্মের আনুমানিক ৮৫ মিলিয়ন বছর পর থেকে একসাথে সংসার করছে। সুখে-দুখে একে অন্যকে সব সময় পাশে পেয়েছে। আর আমরাও এই নিয়ে কত কল্প কাহিনী গল্প ছড়িয়েছি। সেই চাঁদের বুড়ি তো এখনো আছে প্রতিটি শিশুর মনে জীবিত। কিন্তু আমাদের এই ভালোবাসার বাল্য বন্ধু চাঁদ আমাদের থেকে হারিয়ে গেলে কি হবে আমাদের, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি ? চাঁদ শুধু আমাদের রাতের আঁধার দূর করা আর কবি সাহিত্যিকের লিখনির অংশ হতেই আসেনি। এর অবদান আমাদের জীবনের জন্য অপরিসীম। প্রানীকূল সহ পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে চাঁদের ভূমিকা কল্পনাতীত।
চাঁদের অনুপস্থিতিতে আমাদের পৃথিবীর যেসব পরিবর্তন ঘটবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পরবে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতের আঁধারে চাঁদের মিষ্টি আলোর বিকল্প আর কিছুই হতে পারেনা। ইলেক্ট্রিক বাল্ব থাকলেও তা চাঁদের আলোর মত মিষ্টি না। হুম কিছু ক্ষেত্রে দূরের তারা হতে আসা আলোক রশ্মি আলোকিত করবে কিন্তু তা পর্যাপ্ত না।
চাঁদের অভাবে আমাদের পৃথিবীর দিন রাত্রিতেও আসবে বিশাল ফারাক। চাঁদের সাথে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় সম্পর্ক। আর এই আকর্ষণের জন্য পৃথিবীর যে উচ্চো গতি তাতেও এর প্রভাব রয়েছে। অনেকটা প্রাকৃতিক স্পিড ব্রেকার এর কাজ করে। হঠাৎ করে চাঁদ হারিয়ে গেলে এই ঘূর্ণন গতির নিয়ন্ত্রনটাও হারিয়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর গতির অসামাঞ্জস্যতা থাকায় দিন অথবা রাত এর সময়ের পার্থক্য টা হয়ে যাবে কম বেশি। হতেও পারে দিন ৮ ঘন্টা আর রাত ১৬ ঘন্টা কিংবা রাত ৬ ঘন্টা আর দিন ১৮ ঘণ্টা ।
সাগর – নদীর জোয়ার ভাটা কিংবা সাগর এর বিশাল স্রোতের কারন এই চাঁদ পৃথিবীর মধ্যাকর্ষীয় টান। এই টানের প্রভাবে বিশাল স্রোত আর পৃথিবীর এক রকম ঘর্ষন সৃষ্টি হয় যা মিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে হয়ে আসছে। হঠাৎ চাঁদের অনুপস্থিত এই ঘর্ষন থামিয়ে দিবে আর পৃথিবী হারাবে তার স্বাভাবিক গতি। এছাড়াও জোয়ার ভাটার স্বভাব পালটে গিয়ে সব পানির স্রোতের অভিমুখ পরিবর্তন হয়ে যাবে যার ফলে একমুখি স্রোত হবে। পৃথিবীর গতি মুখের বিপরিতে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এমন অনেক প্রানী ও জনপদ আছে যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে হয়ে যাবে। জোয়ার ভাটার অভাবে। অস্বাভাবিক বন্যা আর লবনাক্ততা হবে। আমাদের ঋতু চক্র , আবহাওয়া জলবায়ু সব পালটে গিয়ে এক নিরস নতুন পৃথিবী হয়ে উঠবো। ঝর জলচ্ছাস কোথাও না কোথাও লেগেই থাকবে। সবচেয়ে বড় দুঃখের কারন হয়ে যাবে আমাদের বায়ু মণ্ডল ব্যাপক হারে ক্ষতি গ্রস্ত হবে। আর সৌর রেডিয়েশন তো আছেই আমাদের উচিত শিক্ষা দিতে। হঠাৎ পৃথিবীর গতি বেরে যাওয়া কিংবা চাঁদ দূরে সরে যেতে থাকলে পৃথিবী তার নিয়মিত কক্ষপথ থেকে সরে আসবে , সেই সাথে পৃথিবী যে কৌণিক গতিতে ঘুরছে তারও পরিবর্তন ঘটবে। এর প্রভাব হয়তো ৩৬৫ দিনে বছর না হয়ে ২০০ কিংবা ১০০০ দিনেও বছর হয়ে যেতে পারে। আর দিন ও রাতের কথা সেটাতো সব মিলিয়ে ২৪ ঘন্টা না হয়ে ১৮ ঘণ্টা হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা তখন।
এগুলো তো গেলো প্রকৃতি আর বিজ্ঞান এর বিষয়। হিসেব করে দেখুন গল্প কবিতায় আর চাঁদ থাকবেনা, ছোট্ট সোনামনিকে চাঁদ দেখিয়ে আর চাঁদের বুড়ীর কল্প-কাহিনী শোনানো হবেনা, হানিমুন বলে আর কথাও থাকবেনা, রোমান্টিক হয়ে চাঁদের উপমা কিংবা আমার মত প্রকৃতি প্রেমি নিরিহ মানুষ গুলো ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখে মন সতেজ করতে পারবেনা। আর সেই সাথে পাশের বাড়ির তানভির ভাই এর ছাদে এসে চাঁদ দেখার নাম করে ইসরাতের সাথে ইশারায় আদো প্রেম আদো ভালোবাসা হবেনা। হয়তো ভারতীয় নায়ক সুশান্ত সিং চাঁদে কেনা তার জমিটার জন্য স্বর্গ থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে আর বলবে আমার সব টাকা জলে গেলো রে রে রে রে………।
নাহ সারদিন কাজের চাপে আজকাল বেশিই সব কিছু নিয়ে উলটা পালটা ভাবছি। চাঁদ চুরি করবে এমন কে আছে? চাঁদ মামা সবার। এই নিয়ে অন্তত রাজনীতির কিছু নাই। এতো বিশাল বিষয় নিয়ে আমার মত সাধারণ মানুষ এর এতো ভাবলে হবে না। অফিসের অনেক কাজ আছে সেগুলো সামলাই। চাঁদ কে সামাল দিক আপাতত নাসা কিংবা রাশিয়া অথবা ইউরোপের দেশ গুলোর স্পেস এজেন্সি গুলো । পাড়ার মোড়ের চাঁদ সওদাগর চাচা মাথার মেমরি লস হয়ে হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু আকাশের চাঁদ আপাতত নিরাপদ।
কপি রাইটঃ এস. এম. রাজিব আহম্মেদ
ইন্সট্রাকটর, কম্পিউটার টেকনোলজি
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট