গণিত:বিভীষিকা নাকি সম্ভাবনা! (পর্ব-০১)

গণিত:বিভীষিকা নাকি সম্ভাবনা! (পর্ব-০১)

ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকেই শুরু হয় মানুষের জীবনে গণিতের ব্যবহার। কখন, কোন তারিখে, কোন সালে জন্মেছি—সব ধরনের তথ্য লিপিবদ্ধ করতেই রয়েছে গণিতের প্রয়োগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে জাতি গণিতে যত বেশি পারদর্শী, সেই জাতির বিশ্বময় কর্তৃত্ব করার সম্ভাবনাও তত বেশি। বর্তমানে বিশ্বে গণিতে অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া, চীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গণিত পারদর্শিতার কারণেই এই দেশগুলো বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশের অন্যতম। কম্পিউটারের ভাইরাস প্রগ্রাম, অ্যান্টি-ভাইরাস প্রোগ্রাম, হ্যাকিং টেকনোলজিতে বিশ্বজুড়ে রাশিয়া বিখ্যাত। চীনও কোনো অংশে কম নয়। সব কিছুর মূলে যে শক্তি কাজ করেছে, তা হলো গণিতের শক্তি। কম্পিউটার প্রোগ্রাম এর অ্যালগরিদমের ভাষা হচ্ছে অঙ্ক। প্রোগ্রাম করার আগে গাণিতিক সমাধানই বলে দেবে প্রোগ্রামটি ফলপ্রসূ হবে কি না। মহাশূন্যে মানুষের পদচারণার প্রথম শর্ত ছিল নির্ভুল গাণিতিক হিসাব। নভোযান চালনায় গণিতের জটিল হিসাবের সঠিক ফলাফলই মানুষকে চাঁদে ও ভিনগ্রহে অবতরণের সার্থকতা দিয়েছে।

গণিত! ছোটবেলা থেকে এক বিভীষিকার নাম। এর সূত্র ও কড়া কড়া উপপাদ্য মুখস্ত করতে হয় আমাদের কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের । গণিতের সূত্র হয় শত্রু। গণিতের এর তিক্ত বা মিঠা অভিজ্ঞতা নিয়ে এই ব্লগ লেখার আইডিয়াটি মাথায় আসে। তারই উদ্যোগে বিগত ১১ জুলাই একটি জরিপ করা হয়। (লিংক: https://docs.google.com/forms/u/1/d/e/1FAIpQLSc5KNbuUOpeX9qSUdCF9uVqal2Sf4-xA_3uSbI6IcdpJsN28Q/viewform?usp=send_form) এখানে অংশগ্রহণ করে ৭৫ জন যার বেশিরভাগ আমার শিক্ষার্থি, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মি। জরিপের প্রশ্ন ও ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,

প্রশ্ন – ১

প্রশ্ন – ২

প্রশ্ন – ৩

এছাড়া কোন ক্লাসে পড়া কালীন গণিত কঠিন লাগা শুরু করে? এই প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ নবম শ্রেণির কথা বলেছে। হঠাৎ একেবারে অনেক নতুন নতুন অধ্যায় ত্রিকোনমিতি, পরিমিতি, সম্ভাবনা,স্থানঙ্ক জ্যামিতি সবার কছেই কঠিন লাগতে থাকে।

আপনি কেনো গণিত অপছন্দ/পছন্দ করেন? এবং কেনো?

শিক্ষক এবং ছাত্রদের এ নিয়ে কি করা উচিত বলে মনে করেন? এই বিষয়ে সকলের মতামত নেওয়া হয়।

এই প্রশ্নটি নিয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

 

প্রত্যেক মানুষ অল্পবিস্তর গণিত জানে। জীবনকে নিয়মমাফিক পরিচালনার জন্য ন্যুনতম গণিতের জ্ঞান অপরিহার্য। অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত যারা তারাও গুণতে জানে। গণিত ছাড়া কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে ন্যূনতম গণিতের জ্ঞান রয়েছে। আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে গাছপালা, আকাশ-বাতাশ, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুতে গণিতের ছোঁয়া রয়েছে। গাণিতিক নিয়ম ছাড়া কোন কিছুই চলমান রাখা সম্ভব নয়। এজন্য বলা হয় “গণিত সকল বিজ্ঞানের জননী”।

গণিত কী, এর কোন সর্বজনগ্রাহ্য সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এখনও কেউ দিতে পারে নি। কিন্তু প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে গণিতকে ব্যাখ্যা করতে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন।

গ্রিক ‘ম্যাথেমা’ শব্দ থেকে এসেছে ইংরেজি ‘ম্যাথমেটিক্স’ শব্দটি। গ্রিক ম্যাথেমা এর অর্থ জ্ঞান বা শিক্ষা। জ্ঞানের সমার্থক হবার কারণে গ্রিসে জ্ঞানী বা শিক্ষক প্রত্যেককেই গণিতবিদ বা ম্যাথমেটিসিয়ান বলা হত। আর সেজন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল পণ্ডিত – তিনি ধর্মবিদ, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক যাই হোন না কেন- প্রায় সকলেই গণিতে দক্ষ হতেন। আসলে গণিত ছাড়া কারোই পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব না।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জীবনের সফলতাকে একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, ‘সফলতা= ঢ+ণ+ত; যেখানে, ঢ = কাজ, ণ = খেলাধুলা এবং  ত = অন্যের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকা’। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো গাণিতিক মডেল দ্বারা উপস্থাপন করা যায়। এই উপস্থাপন করার দক্ষতাই কোনো জাতির গাণিতিক জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করে। আমাদের অঙ্ক অনুধাবন করার ক্ষমতা আশাব্যঞ্জক, তবে অঙ্ক শেখার মধ্যে পদ্ধতিগত ঘাটতি রয়েছে। আমরা অঙ্ক শুধু অনুশীলন করে যাই, কিন্তু ওই অঙ্কের ব্যবহারিক বা ফলিত বিষয়গুলো মোটেও ভেবে দেখি না। এ কারণেই ছাত্রজীবনে অঙ্কে খুব ভালো করার পরেও গণিত ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কম্পিউটার সায়েন্স হলো গণিত ও কলার সমন্বয়। বিশ্বকে ডিজিটাল করার মূলে যে প্রগ্রাম তার মূল অবকাঠামো কিন্তু গণিতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বাস্তব জগতের যেকোনো সমস্যা সমাধানের গাণিতিক মডেল রয়েছে। কোনো সমস্যা সমাধানের গাণিতিক মডেলই হচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যালগরিদম। একটি প্রণীত অ্যালগরিদম যখন কাগজে-কলমে সঠিক, তখন ওই অ্যালগরিদম অনুসরণ করে প্রগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ দিয়ে নিয়মমাফিক কোড লিখলেই তা প্রগ্রামে রূপ নেয়। অর্থাৎ প্রগ্রাম হচ্ছে কোনো সমস্যার গাণিতিক সমাধানের এমন একটি রূপ, যা কম্পিউটার বুঝতে পারে। সুতরাং ভালো প্রগ্রামার হওয়ার প্রথম শর্ত হলো ভালো গণিতজ্ঞ হওয়া। ভালো গণিতজ্ঞ হলে যেকোনো সমস্যা গাণিতিক মডেলে রূপান্তরিত করে গণিতের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে গণিত অনুরাগী এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত গ্র্যাজুয়েটদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে গণিত গ্র্যাজুয়েটদের সম্পৃক্ততা এই ক্ষেত্রকে আরো স্বনির্ভর ও শক্তিশালী করে তুলবে।

আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের পরিকল্পনায় যদি গণিত গ্র্যাজুয়েটদের প্রশিক্ষিত করা যায়, তাহলে পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। গণিতজ্ঞ ব্যক্তি প্রগ্রামিংয়ের কলাকৌশলগুলো দ্রুত রপ্ত করতে পারেন। বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ ডোনাল্ড নুত অ্যালগরিদমের ওপর যে বই লিখেছেন তা দিয়েই বিশ্বের প্রায় সব প্রগ্রামিং সমস্যার গাণিতিক সমাধান সম্ভব। তাঁর লেখা বইটির নাম বিল গেটস এই বইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি যদি এই বইটির সব বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝে থাকেন তাহলে আমাকে আপনার বায়োডাটা পাঠান—কারণ নিঃসন্দেহে আপনি একজন ভালো প্রগ্রামার’। ১৬ কোটি মানুষের দেশে গণিত শেখানোর যে কৌশল, তা মোটেও আনন্দনির্ভর নয়। গণিতের নিগূঢ় অর্থ উপলব্ধি করে গণিত শেখার মধ্যে যে আনন্দ, তা আমাদের দেবে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি।

গণিতের ব্যবহার সর্বজনীন। ন্যাচারাল সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, ফিন্যান্স, সামাজিক বিজ্ঞান—সব ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। তাই আমাদের গণিতের ভিত্তিজ্ঞান উন্নয়নের জন্য অনুসরণ করতে হবে সেই দেশগুলোর পাঠ্যক্রম, যেখানে গণিতের উৎকর্ষতা পরীক্ষিত এবং ওই পাঠ্যক্রম ও পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে গণিতজ্ঞ মেধাবী মানবসম্পদ, যাদের নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে আমরা নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করব।

গণিতের জাদুকরী শক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি স্তরকে করতে পারে সাফল্যমণ্ডিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের উচ্চ শিখরে আরোহণে গণিতের শিক্ষা অপরিহার্য। তাই প্রাথমিক শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত গণিত শিক্ষাকে আরো সুসংহত করে গড়তে হবে, যৌক্তিক জ্ঞানসম্পন্ন মেধাবী জনগোষ্ঠী, যাদের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে।

লেখক:

মো: রেজাউর রহমান, ইন্সট্রাক্টর,

ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট

Tags: No tags

Comments are closed.