কারিগরি শিক্ষা আত্ননির্ভশীলতার প্রস্তুতি
কারিগরি শিক্ষা
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। পৃথিবীর যে দেশে যত বেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আছে সেই দেশ তত বেশি উন্নত। মানব সম্পদ যদি ব্যবহারযোগ্য না হয় তবে তার কোন মূল্য নেই। কোন রাষ্ট্রের প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ বা খনিজ সম্পদ থাকলেই, সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত হয়না, যদি না ঐ রাষ্ট্র উপযুক্ত পরিকল্পনায় ঐ সম্পদকে ব্যবহার করতে পারে। একইভাবে রাষ্ট্রে অসংখ্য জনগোষ্ঠী থাকলেই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না। ঐ জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারলে সেই জনগোষ্ঠী রাষ্টের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।।
যে শিক্ষা শিক্ষার্থী তার বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হতে পারে তাই কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষার কয়েকটি ট্রেড রয়েছে যেমন সিভিল ,ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিক্স,মেকানিক্যাল,কম্পিউটার,আকিটেকচার,পাওয়ার, ইত্যাদি ।এই ট্রেড গুলোর যেকোনো একটি ট্রেডে বাস্তবমুখী শিক্ষা গ্রহনের মাধ্যমে আমরা আমাদের বেকারত্বকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। সাধারন শিক্ষা অর্জন করে যেখানে চাকরি নামক সোনার হরিনের পেছনে দীঘদিন ছুটতে হয়,সেখানে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে অনেক ভালো মানের চাকরি পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষা গ্রহন করলে অনেক উন্নত মানের প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি পাওয়া যায়।তেমনি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো DHAKA WASA,BREB,DPDC,EPZ,BANGLADESH RAILWAY,BTRC,PWD এবং BPSC তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সরকারি চাকরি। বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থীকে বা ব্যক্তিকে পেশা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সে নিজেই অর্জিত শিক্ষার সাথে মিল রেখে স্বাধীনভাবে পেশা খুঁজে নিতে পারে। সাধারণ শিক্ষা এর বিপরীত, অর্থাৎ অর্জিত শিক্ষার সাথে কর্মের মিল থাকে না। কারিগরী শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়স সম্পর্কে কিছুটা শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়। সাধারণত ঝরে পড়া শিক্ষার্থী অথবা কোন কারণে শিক্ষাবঞ্চিত ব্যক্তির জন্য কারিগরি শিক্ষা নানাভাবে সফলতা এনে দিতে পারে। এ ধরনের শিক্ষার প্রধান শর্ত হলো ধৈর্য্য, পরিশ্রম ও অনুশীলন। দক্ষতাই উন্নয়ন-এ কথাটি কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ শিক্ষার প্রধান সাফল্য ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ। এর উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী বা ব্যক্তিকে পরবর্তী জীবনে নির্দিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে দক্ষ করে তোলা, নিজ নিজ উদ্যোগে স্থানীয় ছোট ছোট শিল্পের প্রসার ঘটানো, স্বাধীনভাবে পছন্দ অনুযায়ী বৃত্তি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদকে প্রকৃষ্টভাবে কাজে লাগিয়ে কর্মীর হাতে পরিণত করা।
আমাদের দেশের বিপুল সম্ভাবনাময় এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার। প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এদেশের জনসম্পদই হচ্ছে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের একভাগ হচ্ছে ১৫ এবং তদুর্ধ বয়সী কম-উপযোগী মানুষ। দেশে বর্তমানে দারিদ্রের হার ৩০ ভাগেরও উপরে এবং প্রতিবছর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নতুন করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর অধিকাংশই হয় বেকার, না হয় আধা বেকার অবস্থায় থাকে। যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, তারাও দক্ষতার অভাবে স্বল্প বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের জীবনমান থাকে অনুন্নত এবং অভাব হয় নিত্যসঙ্গী। পাশাপাশি আমাদের দেশের প্রচুর লোক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিদেশে যাচ্ছেন। প্রবাস থেকে আমাদের দেশে তারা যে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করেন তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারি দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত এবং এ বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে যে সকল শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যান তার ২৩% দক্ষ, বাকি ৭৭% আধা-দক্ষ বা অদক্ষ। ফলে তারা অন্যান্য দেশের কর্মজীবীদের তুলনায় অনেক কম আয় করেন এবং কম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করেন। আমরা যদি তাদেরকে দক্ষ শ্রমজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারা অধিক উপার্জনসহ মানসম্মত উন্নত জীবনের অধিকারী হতো এবং কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণে সক্ষম হত। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের চাইতে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির হার অনেকগুণ বেশী। অথচ ১৯৭০ সালে এই দেশগুলির জিডিপি আমাদের প্রায় সমকক্ষ ছিলো।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করেছে কারিগরি শিক্ষার ওপর ভর করে। তাদের কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি যুগোপযোগী মানসম্মত কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। এখানে কারিগরি শিক্ষার প্রতি সমাজের অনেকেই এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। সামাজিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যারা পড়াশুনায় ভালো নয় তারা টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল এডুকেশনে শিক্ষা নিতে আসে। যা আজ আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। এর ফলে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক মহল সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। অথচ কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারত।
কর্মমুখী ও ব্যবহারিক শিক্ষার শক্তিই হচ্ছে উন্নয়ন ও জাতি গঠনের আসল শিক্ষা। জাতীয় জীবনে অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি শিক্ষা। হাতে-কলমে শিক্ষাই হচ্ছে একটা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। শিক্ষা যেমন ব্যক্তিজীবনকে আলোকিত এবং উন্নত করে, তেমনি জাতি দেশকে সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করে। ব্যবহারিক শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। হাতে-কলমের শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা ও হীনতা থেকে মুক্ত হয়ে জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পারে। সর্বপরি,বতমানে বেচে থাকার জন্য কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই।
Author:
Sharmin Akter
Junior Instructor
AIDT, Daffodil Polytechnic Institute