ইসলামি সভ্যতা / Islamic civilization

ইসলামি সভ্যতা

 

ইসলামি স্বর্ণযুগ অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময়কালকে বোঝায়। সপ্তম শতকে মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি শক্তির উত্থানের সময় শুরু হয়। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের সময়কে এর শেষ ধরা হয়। ১৪৯২ সালে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আন্দালুসে খ্রিষ্টান রিকনকোয়েস্টার ফলে গ্রানাডা আমিরাতের পতনকেও এর সমাপ্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়। মিশর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র পরিণত হয় এবং উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, আফ্রিকার লোহিত সাগর উপকূল, তিহামা, হেজাজ ও ইয়েমেন এর অন্তর্গত ছিল। এই যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডো‌বা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। 

 

উদ্ভব ও বিকাশ : হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু সালাম ৬১০  খ্রিস্টাব্দে নবুয়্যত 

 প্রাপ্ত হন এবং এরপর থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। তিনি প্রথমে মদিনা কে কেন্দ্র করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তী পর্যায়ে তিনি মক্কাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেন। হযরত মোহাম্মদ সাল্লাহু সালামের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে মুসলিমরা সিরিয়া.ইরাক, মিসর ও ইরানের  একাংশ জয় করে । পাশাপাশি তারা সাসানীয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে। ধীরে ধীরে তারা মধ্য এশিয়ার তাসখন্দ থেকে ইউরোপের পিরেনিজ পর্বতমালা পর্যন্ত সব সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি  ঘটিয়েছিল।

 

খিলাফত : খিলাফত হলো একটি মুসলিম রাষ্ট্র। সময়ের সাথে সাথে খিলাফতের শাসন ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। সাধারণত খিলাফতের প্রধান হিসাবে খলিফা এবং প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের কার্যক্রম পরিচালিত হতো কুরআন ও সুন্নাহর নিয়মানুসারে। খলিফার দরবারে আমির- ওমরাহদের মতামত প্রাধান্য পেত।বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে দেওয়ান- আল-খারাজ বা রাজস্ব বিভাগ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । উদাহরণ স্বরূপ:-

খোলাফা- ই- রাশেদীন ( ৬৩২-৬৬১খ্রিষ্টাব্দ),  উমাইয়া খিলাফত( ৬৬১-৭৫০),  আব্বাসীয় খিলাফত ( ৭৫০-১২৫৮),ফাতেমীয় খিলাফত( ৯০৯-১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ), তুর্কি খিলাফত(১৪৫৩- ১৯২৮)। 

 

সমাজ ও অর্থনীতি

মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ থেকে স্পেনের কর্ডোভা পর্যন্ত পুরো মুসলিম সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক। এ সভ্যতায়  একশোর  বেশি প্রধান নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে  উঠেছিল।  এসব নগর মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও  সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। 

 

ইসলামি সভ্যতা
ইসলামি সভ্যতা

বাসস্থান ব্যবস্থা: কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠত বাসভবন এবং সেগুলো ছিল একটি নগরের প্রাণ।  প্রতিটি বাড়ির সামনে  একটি পানি রাখার স্থান ছিল।  কোন কোন ভবনে হাম্মামখানা থাকতো।  প্রত্যেক নগরের বাহিরে থাকতো একটি  খোলা ময়দান যেখানে ধর্মীয় ও লৌকিক উৎসব পালন করা হতো। নগরের সব শাসনকার্য পরিচালনা করত খলিফা। 

 

সমাজ অবস্থা: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের মর্যাদা সমান ছিল কিন্তু  অর্থনৈতিকভাবে সমাজে বা মানুষের মধ্যে বৈষম্য  দেখা যেত। রাশেদীন  খিলাফতের  পর থেকে খলিফাদের জীবনী বিলাসিতা 

 

পূর্ণ হয়ে ওঠে।  তাদের বংশধর  সমাজ পরিচালনার  দায়িত্ব পায়।  তখন থেকে শুরু হয় সমাজের উঁচু  পদ ও নিচু পদের মধ্যে বৈষম্য।  শুরু হয় দাস প্রথা,  জ্যোতিষ চর্চা, ফকির দরবেশ। 

 

নারীর স্থান: আরব সমাজে নারীর মর্যাদা ছিল সীমিত।  এমনকি আরব সমাজে কন্যাশিশুকে হত্যা করার রীতি প্রচলিত ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সাহায্যে মেয়েদের সম্মানের আসন করে দেন,  সম্পত্তির অধিকার দেন, সমাজে মর্যাদা এনে দেন। কিন্তু অঞ্চল ভেদে নারীদের অধিকারের অবস্থা ভিন্ন ছিল,  অনেক অঞ্চলে তাদের  ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ববোধকে বন্দি করে রাখা হতো।  বলা যায়  এ সময়ে  নারীদের অবস্থা ক্ষুন্ন ছিল।

 

দাসদের অবস্থা: ইসলামী সভ্যতার দাস প্রথার প্রচলন ছিল, তারা ছিল সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষ।  গৃহের কাজে,  ভূসম্পত্তি তত্ত্বাবধানে, সঙ্গীত, নৃত্য বিনোদনের কাজে তাদের ব্যবহার করা হতো।  তাদের  স্বাধীনতা,  সম্মান  বা মর্যাদা ছিল না।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাসদের  মনিব  খুশি হয়ে তাদের মুক্ত করে দিতেন।

 

 অর্থনীতি: ইসলামী সভ্যতায় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  জল ও স্থল উভয় পথেই আরবের মানুষরা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত।  ব্যবসার পাশাপাশি যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ সুবিধাজনক ছিল সেখানে কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠত।  কৃষিজ পণ্য যেমন আঙ্গুর, জলপাই,  গম,খেজুর ইত‌্যাদি উল্লেখযোগ‌্য।  শিল্পের মধ্যে মণিকার,  বস্ত্র বয়ন, জহুরির শিল্প,কাঁচ শিল্প ইত্যাদি  ব্যবসা-বাণিজ্যের জন‌্য ব্যবহৃত হতো।

 

 মানব সভ্যতায় মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা  রেখেছে।  কোরআনকে কেন্দ্র  করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখার সন্ধান পাওয়া গেছে।  তাদের এই  অবদানের জন্য এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য,  ইতিহাস চর্চা,  গণিত ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে।

ইসলামি সভ্যতা
ইসলামি সভ্যতা

চিকিৎসা বিজ্ঞান: অতীতে মানুষরা চিকিৎসা বিজ্ঞান কুসংস্কার ও জাদু মন্ত্র  মনে করত।  মুসলমানরা  মানুষকে এই ভুল ধারণা থেকে মুক্তি দেন।  তারা বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও উপসর্গ নির্ণয় করে সুনির্ধারিত প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেন।  মধ্য যুগে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের উদ্ভাবন এবং বাজারজাতকরণে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।  ধীরে ধীরে মানুষের ভুল ধারণা কেটে যায় এবং সকলেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বাস করা শুরু করেন। পরবর্তীতে  হাসপাতাল তৈরি করা শুরু করেন।

 

গণিত: গ্রিক ও ভারতীয়দের দাঁড়ায় প্রথম গণিত চর্চা শুরু হয়।বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমী  তার গ্রন্থে প্রথম বীজগণিত বোঝাতে  অ্যালজেবরা শব্দটি ব্যবহার করেন।  ইসলামী বিজ্ঞানীদের দ্বারা তৈরি তারকার মানচিত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার সারণি বহু শতাব্দী  ধরে ইউরোপ ও এশিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে। 

 

 সাহিত্য: মুসলিম সাহিত্য শুরু হয় কবিতা কে কেন্দ্র করে।  কাব্য গ্রন্থের মধ্যে লায়লা মজনুর প্রেমের কাহিনী সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সুপরিচিত। গদ্য সাহিত্যের মধ্যে আলিফ লায়লা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সিন্দাবাদ, আলিবাবা  চল্লিশ চোর,  আলাদিন ইত্যাদি গল্পগুলো আরবের গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।  এসব গল্প অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। 

ভূগোল,দর্শন,ইতিহাস চর্চা,স্থাপত‌্য ই‌ত‌্যাদি বিষয়ে অবদান রাখেন মুসলিম সভ‌্যতা।

ইসলামি সভ্যতা
ইসলামি সভ্যতা

আস্তে আস্তে একসময় বিবর্ণ হতে শুরু করে মুসলিমদের গৌরবমাখা সেই স্বর্ণযুগ। এগারো শতকে শুরু হওয়া ক্রুসেড ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তোলে গোটা মুসলিম বিশ্বকে। এর অল্প কিছুদিন পরেই তের শতকে ভেতরে ভেতরে ধুঁকতে থাকা মুসলিম বিশ্বের সামনে এসে দাঁড়ায় আরেক ত্রাস- মঙ্গোলদের আক্রমণ। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ায় গড়ে উঠেছিলো শক্তিশালী মঙ্গোল সাম্রাজ্য। ১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী ও তার মিত্র শক্তিদের সামনে তছনছ হয়ে যায় আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, মঙ্গোলদের এ আক্রমণই ছিলো ইসলামের সোনালী যুগকে ইতিহাসের অধ্যায়ে পরিণত করার মূল নিয়ামক। কালক্রমে একসময় অটোম্যান সাম্রাজ্য উঠে দাঁড়ালেও ইসলামের সোনালী সেই যুগ আর কখনোই ফিরে আসে নি, বরং সোনালী সেই সূর্য কালে কালে অস্তমিতই হয়েছে।

 

লেখক,

শাহনেওয়াজ সেরাজ সুবর্ণা

ইন্সট্রাক্টর অফ আর এস ডিপার্টমেন্ট

ডেফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

 

Tags: No tags

Comments are closed.