পাই (π) নিয়ে কেন এত মাতামাতি?

পাই (π) নিয়ে কেন এত মাতামাতি?

পাই (বড় হাতের অক্ষরটি Π, ছোট হাতের অক্ষরটি π) গ্রিক বর্ণমালার ষোলতম অক্ষর একইসাথে গ্রিক সংখ্যা ব্যবস্থায় পাইয়ের মান হল ৮০। প্রাচীনতম ব্যবহারের মধ্যে, অক্ষর π গ্রিক শব্দ পরিধির(περιφέρεια) সংক্ষিপ্তরূপ ছিল, যার প্রথম বর্ণটি π। এর আগে, গণিতবিদরা বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে কখনও কখনও  বা  হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সর্বপ্রথম ১৬৪৭ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ  তার প্রকাশিত বই ক্ল্যাভিস ম্যাথেমেটিক এবং পরবর্তী সংস্করণগুলোতে δ.π কে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতরূপে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এই অনুপাতকে প্রকাশ করার জন্য  ব্যবহার করেন, অপরদিকে π/δ এর মান ৬.২৮.. আকারে ব্যবহার করতেন  ।

পরবর্তীতে ১৭০৬ সালে গণিতবিদ  সর্বপ্রথম তার প্রকাশিত বই  -তে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে শুধুমাত্র π আকারে ব্যবহার করেন। যদিও তার এই মতবাদ তৎকালীন অনেক গণিতবিদেরা গ্রহণ করেননি। ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত অনেকেই পাইকে প্রকাশ করার জন্য ভগ্নাংশই ব্যবহার করতেন।

বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসার্ধের অনুপাত হিসেবে π = ৬.২৮ … ব্যবহার করেন তার ১৭২৭ সালে লেখা  বইটিতে। এরপর তিনি প্রথম π = ৩.১৪ৃ ব্যবহার করেন তার ১৭৩৬ সালের   এবং তার ব্যাপকভাবে পড়া ১৭৪৮ সালের বইটিতে। তিনি লিখেছিলেন, “যৌক্তিকতার জন্য আমরা এই সংখ্যাটি π হিসাবে লিখব; π হল একক ব্যাসার্ধের বৃত্তের পরিধির অর্ধেকের সমান “। ইউরোপের অন্যান্য গণিতবিদদের সাথে অয়লারের ব্যাপক সম্পর্ক ছিল, যার ফলে গ্রিক বর্ণের ব্যবহারটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা বিশ্বের পরে এর ব্যবহার সার্বজনীনভাবে গৃহীত হয়।

এছাড়াও গণিতের বিভিন্ন অপারেটর, রসায়নে, মেকানিক্স এবং তরল গতিবিদ্যায়, বীজগণিত টোপোলজিতে এমনকি অর্থনীতির বিভিন্ন রাশি প্রকাশে π প্রতীকটি ব্যবহার করা হয়।

১৪ মার্চ বিশ্ব পাই (π) দিবস। পাই কী? পাই (π) গ্রিক বর্ণমালার ষোলতম অক্ষর যা গ্রিক শব্দ পরিধির(περιφέρεια) সংক্ষিপ্তরূপ। সাধারণত বৃত্তের পরিধিকে তার ব্যাস দ্বারা ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায় তা হল পাই। মজার বিষয় হল বৃত্ত যত বড় বা ছোট হোক না কেন পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সবক্ষেত্রে একই। এই পাই নিয়ে গণিতবিদদের কৌতুহল ও গবেষনার অন্ত নেই। আজ পাই দিবস উপলক্ষে পাই সংক্রান্ত কিছু অদ্ভুদ ও মজাদার তথ্য সম্পর্কে আলোচনা করি, যা জেনে আশ্চর্য হবেন।

১. পাইয়ের জন্য π চিহ্ন ২৫০ বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৭০৬ সালে গণিতবিদ উইলিয়াম জোন্স এই প্রতীকটি উপস্থাপন করেছিলেন এবং গণিতবিদ লিওনার্ড অয়লারের ব্যবহারের পর তা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

২. যেহেতু পাইয়ের প্রকৃত মান গণনা করা যায় না, তাই আমরা কোনো বৃত্তের সঠিক এলাকা বা পরিধি খুঁজে পাই না।

৩. মার্চ ১৪ বা ৩/১৪ বিশ্ব পাই দিবস হিসাবে উদযাপন করা হয় কারণ ৩.১৪ পাই এর প্রথম সংখ্যা। সারা বিশ্ব জুড়ে গণিত ভক্তরা এই সংখ্যাটি উদযাপন করেন।

৪. ২৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে ভারতের ভিআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজভির মিনা সর্বোচ্চ দশমিক স্থান মুখস্থ বলে গিনেস বুকে রেকর্ড করেন। তিনি ৭০,০০০ দশমিক স্থান বলতে সক্ষম হন। রেকর্ডের সময় তার চোখ বাধা ছিল এবং তার সময় লেগেছিল ১০ ঘন্টা!

 

বিশ্বাস করতে পারছি না? আচ্ছা, এখানে প্রমাণ আছে:

http://www.guinnessworldrecords.com/world-records/most-pi-places-memorised

৫. আমরা সবাই জানি যে আমরা পাইয়ের প্রকৃত মান খুঁজে বের করতে পারি না কারণ এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। কিন্তু মজার বিষয় হল, আমরা পাইকে ধারা এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি।

৬. পাই মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীরও একটি অংশ। মিশরের লোকেরা বিশ্বাস করত যে গিযার পিরামিডগুলি পাই-এর নীতিতে নির্মিত হয়েছিল। পিরামিডের উলম্ব উচ্চতা ও এর পরিসীমার অনুপাত অনেকাংশে বৃত্তের ব্যাসার্ধ ও এর পরিধির অনুপাতের সমান। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই পিরামিডগুলি সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সুতরাং এর মূলনীতি হিসাবে π থাকার ব্যাপারটি সত্যিই স্থাপত্যবিদ জন্য আকর্ষনীয় করে তোলে।

৭. যদিও ১৪ মার্চ (৩/১৪) পাই দিবস পালিত হয়, তবে উদযাপনের জন্য সঠিক সময় দুপুর ১:৫৯ হয়, যাতে সঠিক সংখ্যা ৩.১৪১৫৯ পৌঁছাতে পারে।

৮. পদার্থবিজ্ঞানী ল্যারি শো সান ফ্রান্সিসকোর এক্সপ্লোরেটোরিয়াম বিজ্ঞান জাদুঘরে ১৪ মার্চকে সর্বপ্রথম পাই দিবস পালন করেন । সেজন্য তাকে প্রিন্স অফ পাই বলা হয়।

৯. পাই নম্বরের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি সম্পূর্ণ ভাষা আছে। কিছু লোক পাইকে এতটাই ভালোবাসে, তারা ক্রমাগত শব্দের বর্ণগুলো সংখ্যা পাই এর সংখ্যার সাথে মিল রেখে একটি উপভাষা আবিষ্কার করে ফেলেন। মাইক কিথ এই ভাষাতে ‘Not a Wake’ নামে একটি সম্পূর্ণ বই লিখেছেন।

১০. অনেকগুলি রেকর্ড রয়েছে যা দেখায় যে, পাই আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগেই বাবিলীয়রা প্রায় ৪০০০ বছর আগেই পাই সম্পর্কে জানত। প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাবিলীয়রা পাইয়ের মান ৩.১৫ গণনা করেন।

১১. অনেক প্রতিভাধর মানুষ পাই এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। আলবার্ট আইনস্টাইন পাই দিবসে জন্মগ্রহণ করেন। ৭৬ বছর বয়সে স্টিফেন হকিংস ও পাই দিবসে মারা যান।

১২. চাইনিজরা পাই এর সংখ্যা খুঁজে পেতে পশ্চিমাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। কেন? অনেক গণিতবিদ বিশ্বাস করেন যে, চীনা ভাষা গাণিতিক গণনার জন্য সহায়ক। চীনা গণিতবিদরা পাই গেমে দুটি কারণের কারণে এগিয়ে ছিলেন; কারণ তাদের দশমিক উল্লেখ ছিল এবং তাদের শূন্য সংখ্যাটির প্রতীক ছিল। সেই সময়ে, ইউরোপীয় গণিতবিদরা আরব ও ভারতীয় গণিতবিদদের সহযোগিতায় তাদের সংখ্যাব্যবস্থায় শূন্য প্রতীকের ব্যবহার শুরু করেছিলেন।

১৩. আমরা পাই নিয়ে এত মাতামাতি করি কেন? কারণ আমরা সবকিছুর মধ্যে সম্পর্ক এবং প্যাটার্ন খুঁজতে ভালোবাসি। পাই সংখ্যাটি এত দীর্ঘ এবং এত রহস্যময় যে গণিতবিদরা এখনও এই সংখ্যা নিয়ে গবেষনা করে চলেছেন।

১৪. ১৮৮৮ সালে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের একজন ডাক্তার দাবি করেছিলেন যে তিনি অতিপ্রাকৃত উপায়ে বৃত্তের সঠিক পরিমাপ শিখেছেন। তিনি তার “অতিপ্রাকৃত” জ্ঞানে এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি ইন্ডিয়ানা আইন পরিষদে একটি বিল পাস করার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যাতে তিনি তার প্রতিভাধর ফলাফলগুলি কপিরাইট করতে পারেন। ফলে যারা পাই এর মান হিসেবে তার মানটি ব্যবহার করবে তাদেরকে এর জন্য মূল্য পবিশোধ করতে হবে! যাইহোক, বিধানসভায় একজন গণিত অধ্যাপক ছিল তিনি পরে প্রমান করে দেখিয়েছেন তার প্রস্তাবিত বিলের পাই এর মানটি ভুল ছিল।

১৫. পাইটি আক্ষরিকভাবে অসীম দীর্ঘ সংখ্যা। কিন্তু ১২৩৪৫৬ নম্বরটি পাই এর ১০ লক্ষ ডিজিট এর কোথাও পাওয়া যায় না। এটি কিছুটা হতাশাজনক কারণ যদি পাইয়ের ১০ লক্ষ ডিজিটের মধ্যে ক্রমানুসারে ১২৪৫৬ না থাকে তবে এটি অবশ্যই সবচেয়ে অনন্য সংখ্যা।

১৬. ব্রিটিশ গণিতবিদ Willam Shanks পাই এর মান বের করতে নিজে নিজে কাজ করেন। তিনি বহু বছর ধরে পাই ডিজিট গণনা করার চেষ্টা করে প্রথম ৭০৭ সংখ্যা বের করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি পাওয়া ৫২৭তম অঙ্ক ভুল ছিল, যার ফলে অবশিষ্ট সংখ্যাগুলো ডিফল্ট ভুল হয়েছিল।

১৭. সংখ্যা পাইটি এত রহস্যময় ছিল যে ডাচ-জার্মান গণিতবিদ Ludolph van Ceulen তার জীবনের বেশিরভাগ সময় পাই এর প্রথম ৩৬ টি সংখ্যা গণনা করেছিলেন। বলা হয় যে প্রথম ৩৬ নম্বর তার সমাধি পাথরের উপর খোদাই করা হয়েছিল, যা এখন হারিয়ে গেছে।

১৮. পাই এর মান গণনার মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে পারি। এটি একটি ডিজিটাল কার্ডিওগ্রামের মতো কাজ করে কারণ এটি কম্পিউটারের প্রসেসরের বিভিন্ন কার্যক্ষমতার স্তরকে নির্দেশ করে।

১৯. এক্সপ্লোরেটোরিয়াম বিজ্ঞান জাদুঘরে, প্রতি বছর পাই দিবসে একটি বৃত্তাকার প্যারেড সংঘটিত হয়। অংশগ্রহণকারী সবাই পাইয়ের একটি করে সংখ্যা ধরে থাকে। পাই দিবস উদযাপন করার প্রধান উদ্দেশ্য হল সবাইকে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহি করে তোলা।

২০. পাই নিয়ে চলচ্চিত্র Pi: Finding Faith in Chaos -এ পাই ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে নায়কের প্রচেষ্টাকে চিত্রিত করা হয়েছে। পাইয়ের প্রতি এই অনুসন্ধান তাকে পাগল করে ফেলে। কিন্তু ভাল ব্যাপার হল এই চলচ্চিত্রটি স্যান্ডেন্স চলচ্চিত্র উৎসবে পরিচালক পুরস্কার লাভ করেছে।

২১. প্রাচীনকালে, গণিতজ্ঞগণ পাই গণনা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তারা একাধিক বাহু বিশিষ্ঠ বহুভুজ ব্যবহার করে বৃত্তাকার এলাকায় পৌঁছেছেন। আর্কিমিডিস, সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রীক গণিতবিদ এবং আবিষ্কারক, ৯৬ বাহু বিশিষ্ঠ বহুভুজ ব্যবহার করেছিলেন। বহু অন্যান্য গণিতবিদগণ এই বহুভুজের পদ্ধতিতে পাইয়ের মান গণনা করেছেন। চীনে, একজন গণিতবিদ বহুভুজে প্রায় ২০০ এবং তারপরে ৩,০০০ টিরও বেশি বাহু ব্যবহার করে পাইয়ের মান ৩.১৪১৫৯ বের করতে সক্ষম হন!

২২. পাই এর ব্যবহার বছর এর পর বছর বিস্তিৃত হয়েছে। ১৭ শতকের আগে, পাই শুধুমাত্র বৃত্তাকার ক্ষেত্রের মানসমূহ বের করতে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ১৭ শতকের মধ্যে, লোকেরা বুঝতে পেরেছিল যে বক্ররেখা এবং হাইপোসাইক্লয়েড সহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি গণনা করতে পাই ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০ শতকের মধ্যে, পাইটি সম্ভাব্যতা এবং বিভিন্ন গাণিতিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

২৩. পাইয়ের সংখ্যাগুলো গণনা করা কঠিন হলেও পাইয়ের মান দ্বারা অন্যান্য জিনিস গণনা করার ক্ষেত্রে এটি অনেক কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা দশমিকের পরে মাত্র ৯ ডিজিট নিয়ে পৃথিবীর পরিধি গণনা করার জন্য এটি ব্যবহার করি তবে ফলাফলগুটি অসাধারণভাবে সঠিক হবে। প্রতি ২৫,০০০ মাইলের জন্য শুধুমাত্র একটি ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ ভুল হবে।

২৪. পাই এতই আশ্চর্যজনক এবং রহস্যময় যে এটি চলচ্চিত্রে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৯৬ থ্রিলার চলচ্চিত্র টর্ন কার্টেনে, পাই হল গোপন কোড।

২৫. পাই এর ডিজিটসমূহ কে কার চেয়ে বেশি গণনা করতে পারে এ নিয়ে সর্বদা প্রতিযোগিতা চলছে। ২০১০ সালে জাপানী প্রকৌশলী এবং আমেরিকান কম্পিউটার উইজার্ড পাইয়ের ৫ ট্রিলিয়ান ডিজিট সংখ্যা গণনা করে সর্বাধিক সংখ্যক পাইয়ের ডিজিট গণনার রেকর্ডটি ভাঙ্গে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার তারা কোন সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করেননি। তারা তাদের অসাধারণ কল্পনাশক্তি আর শুধু সাধারণ ডেস্কটপ কম্পিউটারের সাথে ২০টি এক্সটার্নাল হার্ডডিস্ক ব্যবহার করে এ মানটি বের করেন।

 

পরিশেষে শুধুমাত্র বৃত্তাকার ক্ষেত্রে নয় পাই পরিসংখ্যান, ত্রিকোণমিতি, বিস্তার পরিমাপ, অর্থনীতিসহ ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যপক ব্যবহার হয় যা একে করে তুলেছে সত্যিই অনন্য ও অসাধারণ। সকলের জীবন পাইয়ের মত সুন্দর হোক!

 

লেখক,

মো: রেজাউর রহমান, ইন্সট্রাক্টর,

ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট।

 

Tags: No tags

Comments are closed.