বাক্সে-জমা শিক্ষা
আজকে আসলে আমি শিক্ষাটাকে আমরা কিভাবে বাক্স বন্ধ করে রাখি, বাক্সের মধ্যে জমা করে রাখি সে ব্যাপার নিয়ে কিছু বলব-
স্কুলের বাইরে বা ভেতরে – যেকোনো স্তরে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ককে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে এর বর্ণনাধর্মিতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে বর্ণনাকারী বক্তা ( শিক্ষক) এবং মনোযোগের সাথে শ্রবণকারী শ্রোতা ( ছাত্র) । মূল্যবোধ বা বাস্তবতার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, তা যে বিষয়বস্তুকে ঘিরেই হোক না কেন, বর্ণনার প্রক্রিয়ায় জীবনরিক্ত ও অসার হয়ে ওঠে। শিক্ষা এখন বর্ণনাত্নক অসুস্থতায় ভুগছে।
শিক্ষক এমনভাবে বাস্তবতার কথা বলেন যেন তা গতিহীন, স্থির, কুঠুরিবদ্ধ এবং তাকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। অথবা, তিনি এমনসব বিষয়ের অবতারনা করেন যা ছাত্রদের অস্থিত্বের অভিজ্ঞতার সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। তাঁর কাজ হচ্ছে কোনো কিছু বর্ণনা করে ছাত্রদের মগজ ‘পুরো’ করে দেওয়া। সেই বর্ণনা ও বিষয়বস্তু বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন, সমগ্রতার সাথে সম্পর্কহিত। যে সমগ্রতা তাদের বিপদাপন্ন করেছে এবং যে সমগ্রতা– শিক্ষা সম্পর্কিত তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তার সাথে কোন যোগ নেই এই শিক্ষার। শব্দকে তার যথার্থতা হতে দূরে সরিয়ে তাকে ফাঁপা, বিচ্ছিন্ন এবং খাপছাড়া বকবকানিতে পর্যবসিত করা হয়।
আরো খারাপ ব্যাপার হলো এই যে, এ ধরনের শিক্ষা ছাত্রদের ‘বাক্সে’ পরিণত করে; সেই বাক্স পুরো করার দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষকের ।যত সুষ্ঠুভাবে শিক্ষক সেই বাক্স পূর্ণ করতে পারে তত যোগ্য সেই শিক্ষক। যত নিরীহভাবে ছাত্র সেই বাক্স পূর্ণ করতে পারে তত যোগ্য সেই শিক্ষক। যত নিরীহভাবে ছাত্র সেই বাক্স পূর্ণ করার ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে তত ভালো সেই ছাত্র।
ফলে শিক্ষা হয়ে ওঠে জমা করার বিষয়; যেখানে ছাত্ররা জমা রাখার পাত্র আর শিক্ষকগণ হচ্ছেন জমাকারী। যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বদলে শিক্ষকগণ ইশতেহার জারি করেন, বিদ্যা জমা রাখেন– ছাত্ররা তা মুখস্ত করে আর তার পুনরাবৃত্তি করে। এটি হচ্ছে শিক্ষার ‘ ব্যাংকিং লেনদেনের ‘ ধারণা। এতে ছাত্রদের ভূমিকা হচ্ছে জমা করা জিনিস গ্রহণ করা, নথিবদ্ধ করা আর জমা রাখা।
এটি সত্যি যে, যে –সামগ্রী তারা জমা করে সেগুলোর সংগ্রাহক বা ‘কেটালগার’ হতে পারে ছাত্ররা। কিন্তু অন্তিম বিশ্লেষণে এই পদ্ধতিতে মানুষ সৃজনশীলতা, পরিবর্তন এবং জ্ঞানের অভাবে যান্ত্রীক হয়ে পড়ে। কারণ, অনুসন্ধিৎসা আর প্র্যাক্সিস ব্যতীত মানুষ সত্যিকার মানবিক হয়ে উঠতে পারে না। আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কারের মাধ্যমে, এই বিশ্বে, এই বিশ্বের সাথে, একে অপরের সাথে, মানুষ যে অস্থির, উদ্দাম, অবিরাম ও আশাপ্রদ অনুসন্ধান চালায়, তাতেই শুধু জ্ঞানের সৃষ্টি হয়।
ব্যাংকিং ধারণায় জ্ঞান হচ্ছে একটি দান সামগ্রী– যারা পুরোপুরি অজ্ঞ বলে বিবেচিত তাদেরকে প্রদেয় পন্ডিতমন্যদের দান। অন্যদের ওপর পুরোপুরি অজ্ঞতা আরোপ হচ্ছে অত্যাচারীর আদর্শের চরিত্রলক্ষণ; এই আদর্শ শিক্ষা এবং জ্ঞানকে অনুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে অগ্রাহ্য করে। শিক্ষক নিজেকে ছাত্রের বিপরীত মেরুতে দাঁড় করান; ছাত্রদের অজ্ঞতা চরম বলে বিবেচনা করে তিনি তাঁর অস্তিস্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হেগেলীয় দ্বন্দ্বের ক্রীতদাসের মতো বিচ্ছিন্ন থেকে ছাত্ররা শিক্ষকের অস্তিত্বের প্রশ্নে নিজেদের অজ্ঞতা মেনে নেয়। কিন্তু কখনো অনুধাবন করতে পারে না যে, তারাও শিক্ষকদের শিক্ষিত করে তোলে।
অপরপক্ষে মুক্তিদায়ী শিক্ষার যৌক্তিকতা এই যে, এটি সমন্বয় সাধনে প্রবৃত্ত হয়। ছাত্র–শিক্ষকের দ্বন্দ্বের সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষার যাত্রা শুরু করতে হবে; দুই মেরুর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে– যাতে উভয়েই একই সাথে ছাত্র ও শিক্ষক হয়ে ওঠে।
ব্যাংকিং ধারণার মধ্যে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং, উলটো ব্যাংকিং পদ্ধতির শিক্ষা বিরাজমান দ্বন্দ্বকে রক্ষা করবে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তীব্রতর করবে।অত্যাচারী সমাজের চারিত্রলক্ষণ নিম্নবর্ণিত মনোভাব ও আচার আচরণের মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেঃ
১। শিক্ষক শিক্ষা দেন এবং ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে।
২। শিক্ষক সবকিছু জানেন এবং ছাত্ররা শিক্ষার কিছুই জানে না।
৩।শিক্ষক ভাবনাচিন্তা করেন আর ছাত্ররা হচ্ছে তার ভাবনা চিন্তার বিষয়।
৪। শিক্ষক কথা বলেন , ছাত্ররা চুপচাপ শোনে।
৫।শিক্ষক শৃংখলা আনয়ন করেন এবং ছাত্ররা শৃংখলা মেনে চলে।
৬।শিক্ষক নির্বাচন করেন এবং তাঁর পছন্দ প্রতিষ্ঠা করেন, ছাত্ররা তা মেনে চলে।
৭। শিক্ষক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন; শিক্ষকের কর্মের মধ্যদিয়ে ছাত্ররা কাজ করার স্বাদ লাভ করে।
৮। শিক্ষক কর্মসূচির বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন, ছাত্ররা তা অনুসরণ করে।
৯। শিক্ষক জ্ঞানের কর্তৃত্বকে তার নিজের পেশাগত কর্তৃত্ব বলে ভুল করেন। ফলে ছাত্রদের স্বাধীনতার বিপরীতে তাঁর কর্তৃত্বই বজায় রাখে।
১০। শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বিষয়ী, ছাত্ররা হচ্ছে শুধু বিষয়।“
লেখক,
=====================
সোমা রানী দাস
বিভাগীয় প্রধান