অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর নেদারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডেলফটের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফিলিপ অ্যান্টনিজ ভন লিউয়েনহুক ছিলেন একজন সামান্য ঝুড়ি প্রস্তুতকারক। এই ঝুড়ি তৈরিতে সাহায্য করতেন তার স্ত্রী মার্গারেটা ডেল ভন ডেন বার্খ। তবে এই ঝুড়ি তৈরিও বেশিদিন চললো না। শিশু লিউয়েনহুকের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে দিতেই যেন পরকালে পাড়ি জমালেন তার বাবা।তাই লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি নিতে হয় এক মুদির দোকানে। কয়েক বছর পর জুটল নগর সভার ঝাড়ুদারের কাজ। লেভেল ছোটবেলায় দেখেছিলেন চশমার দোকানে কিভাবে কাচের টুকরো ঘষে ঘষে লেন্স বা আতশি কাচ তৈরি করা যায়। এই কাচের ভিতর দিয়ে তাকালে কোন জিনিসকে সামান্য একটু বড় দেখা যায়। খুব সামান্যই একটু খানি বড়। কিন্তু তাই বা কম কি। লেভেন হুক অবাক হয়ে ভাবলো কাচ আরো ভালো করে ঘষলে হয়তো তার ভেতর দিয়ে সব জিনিস আরো বড় দেখাবে। সেই থেকে ওই এক নেশা তাকে পেয়ে বসল। রোজ যেত চশমার দোকানে এবং দেখতো কি করে কাচ ঘষে। তারপর বাড়ি ফিরে চেষ্টা করত ছোট ছোট কাচের টুকরো তার চেয়ে ভালোভাবে ঘষে নিখুঁতভাবে তৈরি করতে।তবে হাতে ঘষে ঘষে লেন্স তৈরি করা বড্ড খাটুনির কাজ।অনেক দিনের চেষ্টার পর এমন একটি লেন্স তৈরি করে ফেললো যে তার ভেতর দিয়ে কোন কিছু ২০০-৩০০ গুন বড় দেখায়। এমন কি কাচের লেন্সগুলো বসিয়ে নিল তামার ও পাতের ছোট্ট ছোট্ট ফুটোয় উপর। সে এটির নাম দিল অণুবীক্ষণ যন্ত্র অর্থাৎ যার ভিতর দিয়ে খুব ছোট ছোট জিনিস অনেক বড় দেখায়। লেভেন হুক যেন তার তৈরিকৃত যন্ত্র নিয়ে একেবারে মেতে উঠলো। এখন সে তার ছোট ছোট লেন্সের মধ্য দিয়ে সর্বদা তাকিয়ে থাকে। আর দেখতে থাকে তার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন জিনিস যেমন শরীরের ত্বকের লোমকূপ,ত্বক, চুল ইত্যাদি। সে যেন দেখতে পায় এক নতুন জগৎ যেখানে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যায় না। যা রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। এলফর্ডের বোকা লোকেরা এই আধা পাগলকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
লিউয়েনহুক তার জীবনে ৫০০ এর অধিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এগুলোর কোনোটিই আজকের মাইক্রোস্কোপের সাথে তুলনীয় নয়। তথাপি আমাদের জন্য আরেকটি বিস্ময় জাগানো ব্যাপার হচ্ছে তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আলোক সৃষ্টির কোনো উৎস নেই। অথচ এই মাইক্রোস্কোপের দ্বারা তিনি মানবজগতের কাছে উন্মোচিত করেছেন অণুজীবদের এক অচেনা, অজানা, বিশাল জগত!
নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে লিউয়েনহুক এতটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন যে তার মৃত্যুর প্রায় একশ বছর পর্যন্ত আর কোনো জীববিজ্ঞানী এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করেননি। এক ফোঁটা রক্ত কিংবা ডোবার জল, ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের নিখুঁতভাবে কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পেশি আর গাছগাছালির ছাল। এসব নমুনা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে স্থাপন করার আগে তিনি এগুলো এত সূক্ষ্মভাবে কাটতেন যে এগুলোর মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করতে পারতো। ফলে এদের ভেতরের গঠনও স্পষ্টভাবে ভেসে উঠতো তার চোখে।
১৬৭৬ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তিনি ডোবার পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। ব্যাকটেরিয়া এতই ক্ষুদ্র যে তা খালি চোখে দেখা যায় না। তিনি অনুমান করলেন যে একটি বালুর কণার সমআয়তন জায়গা পূরণ করতে ১০ হাজারের অধিক ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন হবে।
১৬৭৭ সালে লিউয়েনহুক আবিষ্কার করেন স্পার্মাটোজোয়া তথা শুক্রাণু। এই আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন যে শুক্রাণু যখন ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে, তখনই নিষেক ঘটে। ১৬৮৩ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। তিনি একপ্রকার সাদা তরল বিশিষ্ট সূক্ষ্ম কৈশিক নালী আবিষ্কার করেন, যাকে আমরা এখন লসিকানালী বলে চিনি।এসবের বাইরেও তিনি শূককীট এবং মাছির জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেন। পার্থেনোজেনেসিস পর্যবেক্ষণকারী প্রথম ব্যক্তিও লিউয়েনহুক। এমনকি উইলিয়াম হার্ভের আবিষ্কৃত রক্ত সঞ্চালন নিয়েও তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। লসিকানালী দিয়ে লসিকার প্রবাহ লক্ষ্য করে তিনি হার্ভের পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে সিদ্ধান্ত জানান।
অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ২৬ আগস্ট, ১৭২৩ সালে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ডেলফটের ‘ওল্ড চার্চ’ কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
লিউয়েনহুকের জীবন ছিল চক্রাকার। একটি বিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহ্যের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়ালেখাই করতে পারেননি। অর্জন হয়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। অথচ মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীববিজ্ঞানী, যিনি অনেকগুলো মৌলিক আবিষ্কার করে গেছেন। রবার্ট হুকের কোষ আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় লিউয়েনহুকের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড বিজ্ঞানের এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়ে যায়, যার নাম ‘মাইক্রোবায়োলজি’ বা অণুজীববিজ্ঞান। তাই মাইক্রোবায়োলজির জনক হিসেবে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।
Source : Google
=======================================
লিখেছেন:
জান্নাতুল ফেরদৌস
ইন্সট্রাক্টর
ডিপার্টমেন্ট অফ ফিজিক্স
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট