সফলতা কোন স্বপ্ন নয় (Success is not a dream)
আসরের নামাজ শেষে বিকেলের খেলার মাঠে প্রাচীর টার উপরে গিয়ে বসলাম মহল্লার বাচ্চাদের খেলা দেখতে। একটু দুরেই বসে ছিলো আমার বড় চাচার সদ্য এসএসএসি পাস করা নাতী। দূর হতেই বুঝা যাচ্ছে বেশ মন খারাপ তার। সামনে দিয়ে চলা ভাজা ওয়ালাকে ডেকে দুটো ঠোংগায় ভাজা দিতে বললাম। সাদিক, বড় চাচার নাতীর নাম। সাদিক কে ডেকে ইশারা করলাম আমার কাছে আসতে । ছেলেটিকে সবসময় খুব কাছে থেকে দেখছি। ইশারা করায় সাদিক কাছে এসে বসলো। স্বভাবতই আমাকে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করলো। আমাকে সে অনেকটা এল্ডার ফ্রেন্ড হিসেবেই মানে। ছোট খাটো সমস্যা কিংবা বড় সমস্যা প্রায়শই আমার কাছে এসে শেয়ার করে। বিশেষ করে যখন রাতে ছাদে যাই এই বধ্য শহরের ব্যাস্ততা ছাড়িয়ে একটু তারা ভরা আকাশের কাছাকাছি হতে তখন সাদিক কিভাবে যেন টের পেয়ে আমার পিছু পিছু চলে আসে। যাইহোক আমার পাশে বসায় আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে মাথার চুল গুলোই হাত বুলিয়ে বললাম “কি রে মন খারাপ কেন ? বাসায় ঝামেলা বাধাইছিস ? নাকি খেলতে এসে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করেছিস?” সাদিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো “ আর বলোনা ছোট চাচা, জানো আমি না সব কিছুতেই ব্যর্থ। আমাকে দিয়ে আসলে কি কাজ টা হবে বুঝিনা। এই ধরো লেখাপড়া বলো কিংবা খেলাধুলা সব কিছুতেই কেন জানি আমার ভালো কিছুই হয়ে উঠেনা। আসলে আমি কোন কাজেরই না।“ আমি আবারো মুচকি হেসে বললাম “ কে বলেছে তুই সফল না? ভেবে দেখ তুই যাইই করেছিস তুই তোর সর্বোচ্চ টুকু দিয়েই করেছিস। তোর চেষ্টা আর পরিশ্রম ছিলো সাধ্যমত আর বাকিটা ভাগ্য। “ সাদিক তখন আবার মন খারাপ করে বললো “ আচ্ছা তাহলে তুমি বলছো যে আমার ভাগ্য তেমন সায় দেয়নি তাইতো?” আমি বললাম “ উহু-না, সব যে ভাগ্যের পরিহাস তা বলবোনা, কিছুটা তোর অবচেতন মনের গাফিলতিটাও দায়ী যা ঠিক করতে তোকে আরো আত্ববিশ্বাসের সাথে সঠিক কৌশলে পরিশ্রম করতে হবে। “ সাদিক বললো, “ বুঝলাম, কিন্তু খেয়াল করে দেখো আমার জীবনে সফলতার চেয়ে ব্যার্থতাই বেশি। এইযে দেখো, আমার এসএসসির রেজাল্ট টা কিভাবে যেন এ+ ছুটে গেলো। এখন আমার এই ব্যার্থতাটাও আমার লাইফে যোগ হয়ে গেলো সব সময়ের জন্য। আমি এখন কোথায় ভর্তি হবো বা আমার লক্ষ্যটা কি হবে তা জানিনা। খুব হতাশ লাগছে। আর খেলাধুলায় দেখো, কোন দিন জিততে পারলাম না কোন প্রাইজ। স্কুল সাইন্স প্রজেক্টে অংশ নিয়েও কোন সুবিধা করতে পারলাম না। আমার সফলতাটা আসলে কোথায়?” আমি সাদিকের দিকে ঝালমুড়ির ঠোংগাটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম “ তুই কিন্তু এই মাত্র সফল হইলি আবারো। বিষয়টা আমি পরে বুঝিয়ে বলছি। তার আগে বলতো সুযোগ আর ভাগ্য বলতে কি বুঝিস?” সাদিক, “ এখন মাথায় কিছু আসছেনা তুমিই বুঝিয়ে বলো।“ আচ্ছা তাহলে আমি ব্যাখ্যা করি তুই মন দিয়ে চুপ করে ঝাল মুড়ি খা আর শোন।
মনেকর আজ খুব বৃষ্টি হয়েছে। এতো বৃষ্টি হয়েছে যে বাসার সামনে ভালোই কাঁদা পানি জমেছে। স্বাভাবিকভাবে সেখানে ইট ফাঁকা-ফাঁকা করে রাখা আছে যেন একটা ইট থেকে আরেকটা ইট এ ধাপ ফেলে-ফেলে কাঁদা পানিটুকু পার হওয়া যায়। এখন তুই সেই কাঁদা পানিটুকু পার হতে সভাবতই প্রথমে একটা ইটে পা রেখে পরের ইটে ধাপ ফেলে যাবি, তাইনা? এই যে একটা ইটের পর আরেকটা ইটে সিরিয়ালি সিকোয়েন্স মেনে একটা একটা করে ইট সফল ভাবে পার হচ্ছিস এটা হলো সুযোগ। সুযোগ সঠিক বুদ্ধির সাথে সঠিক পরিশ্রমে একের পর এক আসবে আর তা সুকৌশলে গ্রহণ করতে হবে তাহলে লক্ষ্যে পৌছানো যাবে। এই সুযোগ ব্যাবহার করে লক্ষ্যে পৌছানো যাবে কিন্তু অনেক পরিশ্রম সঠিক সিদ্ধান্ত ও অভিজ্ঞতা দিয়েই সময় সাপেক্ষে তা অর্জন হবে। তাহলে সুযোগ হচ্ছে তা যা সময়ের সাথে-সাথে সিকোয়েন্স অনুসারে একের পর এক আসবে। সুযোগ ধনাত্বক, এর ঋনাত্বক রুপ নাই। তাহলে ভাগ্য কি? তাইতো? ভাগ্য হলো অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ যা ধনাত্বক অথবা ঋনাত্বক হতে পারে। এখন মনে কর তুই সিকোয়েন্স অনুসারে সুযোগ পেয়েই যাচ্ছিস আর তা সফল ভাবে একের পর এক ইট এর ধাপ গুলো পার করছিস। হঠাৎ তুই খুব সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে দিলি এক লাফ যার ফলে গিয়ে পৌছুলি শেষ স্থানে কিংবা মাঝের কয়েকটা ইট গ্যাপ দিয়ে দু তিনটা ইট পার করে আরেকটা ইটে ধাপ রাখলি। এটা হলো ভাগ্য, যাকে পজিটিভ ভাগ্য বলে। যদি কোন কারনে পা ফোসকে পানিতে পরতি তাহলে হতো ঋনাত্বক ভাগ্য। অর্থাৎ, ভাগ্যের কারনে ঠিকই সুযোগ ওভার টেক করতি কিন্তু পানিতে পরে যাওয়ায় তা কার্যকরি ফল হয়নি। তখন নিজ থেকেই বলে উঠতি ধুর ভাগ্য খারাপ তাই পানিতে পরলাম। আর যায়গা মত পৌছালে বলতি ভাগ্য ভালো তাই পানিতে পরিনি কিন্তু যায়গামত পৌছিয়েছি। দুটো অবস্থাই কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি। আবার এমনও হতে পারে ইটের ধাপ পার হওয়ার সময় কেউ এসে তোকে কাঁধে তুলে নিয়ে পার করে দিলো যা কিন্তু ইটের ধাপ গুলোর সুযোগ কে ওভার টেক করে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি। সমাজে এই প্রাপ্তিটা একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয় যাদের ক্ষমতা আছে। ঠিক একই ব্যাক্তি যদি কাঁধে নিয়ে পার করার সময় স্লিপ করে পরে যায় আর দুজনাই যদি কাঁদা পানিতে মাখামাখি হয়ে যায় তাহলে ঋনাত্বক ভাগ্য প্রাপ্তি। যাইহোক, এই ইটের ধাপ কিংবা ব্যাক্তির সাহায্য শুধু মাত্র রুপক মাত্র যা জীবনের এগিয়ে চলার পথকে নির্দেশ করেছি। এখন বিষয় হলো মানুষ সুযোগ পায় নিয়োমিত কিন্তু তা সঠিক সময় উপোযোগী সিদ্ধান্ত ও সঠিক কৌশলে পরিশ্রম করে প্রাপ্তি নিতে দ্বিধা করে। সবাই শুধু ভাগ্য প্রাপ্তিতে চেয়ে থাকে এই জন্য সমাজে ধনাত্বক প্রাপ্তি আর ঋনাত্বিক প্রাপ্তির এত হায় হতাশা। এখন বলি একটা অস্বীকৃত সফলতার কথা। সাদিক তুই কি জানিস যে মানুষের সফলতার হার তার ব্যার্থতার চেয়েও বেশি! …………… সাদিক, “কি বলো ভাইয়া! কিন্তু কিভাবে?”
ছোট বেলা থেকেই আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রেই ছোট-ছোট সাফল্য পেয়েছি যা আমাদের বড় প্রাপ্তি দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা এই ছোট-ছোট সফলতা গুলো চাহিদা, লোভ কিংবা অতিকাঙ্খার জন্য ঢেকে যায়। যেমন আমরা ছোট-ছোট প্রতিটা পদ ধাপ দিয়েই একটা রাস্তা কিংবা লক্ষ্যে পৌছাই। একটা রোবট যখন চলতে থাকে তখন যদি এই ধাপ গুলো প্রতিটা নজর রাখতো তাহলে তার প্রতি ধাপের সফল প্রোগ্রামিং এর জন্য সাকসেস সাকসেস এই আউটপুট দিতো। ঠিক এই রকম আমরা মানুষ জীবনে কতবার সফল ধাপ ফেলেছি বলতে পারবে কেউ? আবার আমরা কতবার সফল ভাবে খাদ্য গ্রহণ, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া, কথা বলা, শোনা ও হাসি আনন্দের প্রকাশ ইত্যাদি সফল ভাবে প্রকাশ করেছি তার কোন হিসেব নেই। এই গুলো সফলতা প্রাপ্তি আমরা খুব নগণ্য করে দেখি, কিন্তু এই প্রাপ্তি সফলতা গুলোই আমাদের বড় বড় প্রাপ্তি যোগ করে। একটু আগে সাদিক তুই নিজেই তো সফল ভাবে ঝালমুড়ির ঠোংগাটা হস্তগত করেছিস। বড় বড় সফলতা পেতে ছোট-ছোট সফলতা গুলোকেও মূল্যায়ন করা শিখতে হবে, অনুধাবন করতে হবে, উপভোগ করতে হবে। একটা ব্যার্থতার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত কত হাজার হাজার সফল চলাচল ভাবনা কিংবা মুহূর্ত যায় তার কেউ হিসেব রাখেনা। ব্যার্থতা তো শুধু এই হাজারো কোটি সফলতার গল্পের ছোট্ট একটা মুহূর্ত যা আমরা বেশি প্রায়রিটি দেই। ব্যার্থতা একটা ঘটনার মুহুর্ত ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের সাফল্যতাকে মূল্যায়ন করা শিখতে হবে। একটা দৌড় খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য সফলতা থাকে যার মধ্যে প্রতিটা সুযোগ সিকোয়েন্স অনুসারে সফলভাবে দেহ মন সম্পাদন করে। আর দৌড় এর সেই ফাইনাল লাইন টা হলো লক্ষ্য বা ভবিষ্যৎ যা সবারই স্বপ্ন, লাইনটি না ছোঁয়া পর্যন্ত তা বাস্তব নয়। লাইনটি ছোঁয়ার পর সেই স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না, তা হয়ে যায় সফল বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতায় আমরা সবাই পৌছাই কোন না কোন ভাবে। হয় সঠিক সময় উপযোগী সুযোগ পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা প্রাপ্তিতে আর নয়তো ভাগ্য। হ্যাঁ, ভাগ্য তা তো ধনাত্বক কিংবা ঋনাত্বকও হতেই পারে। তাই ভাগ্য দুরের কথা তার দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে পরলে চলবেনা, “সুযোগ” যা বর্তমান সিকোয়েন্স মেনে আসবে সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্তে সঠিক কৌশলী পরিশ্রমে, আর এটাই সফলতা। সাদিক এতক্ষণে মনোযোগ দিয়ে সবকথা চুপ করে শুনছিলো, তার মুখের অভিবাক্তি দেখে মনেহলো সে তার উত্তরটি পেয়ে গেছে । দূরে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে আমি বললাম চল এতক্ষণ অনেক কথা হল এবার আমরা পরকালের সাফলতার জন্য কিছু এবাদত করে আসি।
কপি রাইটঃ এস. এম. রাজিব আহম্মেদ
ইন্সট্রাকটর, কম্পিউটার টেকনোলজি
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট