গনিতের ইতিহাস
গণিত করতে বসলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, মস্তিস্ক কোন কাজ করে না, নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে – গবেষকদের মতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় বিশ শতাংশ এই ধরনের গণিত নিয়ে ভীতিতে ভুগে থাকে। ফরাসি স্কুল ছাত্র লরেন সোয়াজও গণিত নিয়ে এ রকম ভীতিতে ভুগতেন। গণিতকে ভয় পাওয়া সেই লরেন সোয়াজ পরবর্তীতে গণিতের সর্বোচ্চ সম্মান ফিল্ডস মেডেলে ভূষিত হয়েছিলেন।
গণিত শিখতে চাইলে প্রথমে গণিতকে নিয়ে যে ভয়, সেই ভয়টাকে জয় করতে হবে।
গণিতে দক্ষতা অর্জন করতে হলে –
১। ইতিবাচক হওয়া – গণিত মানেই যুক্তি । যুক্তি বুঝতে অনেকেরই অনেক সময় লাগে। কিন্তু তার মানে এই না যে, এমন চিন্তা করব ” গণিত আমার জন্য নয়” বা আমি হয়ত এটা পারবো না” বা এটা পড়ার সামর্থ্য হয়ত আমার নেই।” আমি গণিতে দুর্বল ।
২। মুখস্থ না করে বুঝে করা – গণিত বুঝে করতে হবে। যদি বুঝে প্রতিটি কর, তাহলে সব জটিল সমস্যা সহজ হয়ে যাবে।
৩। অনুশীলন করা – যে গণিতগুলো পারি, সেগুলো আবার করলে কোন ক্ষতি নেই। বেশি কে অনুশীলন করলে গণিত দেখলেই বুঝা যায় সমাধান কিভাবে হবে। নিরন্তর অনুশীলন হল নিখুত ও নির্ভুলভাবে গণিত জয় করার চাবিকাঠি।
৪। গণিত শুধু বুদ্ধির খেলা – যে কোন জিনিষ উদাহরণ দিয়ে শিখলে তা অনেক ভালভাবে বুঝা যায়। তাই কোন গাণিতিক সমস্যা সমাধানের সময় উদাহরণ দিয়ে চিন্তা করলে সহজে সমাধান করা যায়।
বেশির ভাগ মানুষের এই গনিত কিংবা সংখ্যার প্রতি বিদ্যমান ভীতি লুকিয়ে আছে তাদের মস্তিস্কে। যারা গণিতকে ভয় পায় তাদের অনেকের মনেই এই ধারণা বদ্ধমূল যে তারা গনিতে খারাপ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা কিছু উল্টো। গণিত নিয়ে ভয়ে থাকে বলেই তাদের গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা কম।
গণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আর আবশ্যিক বিষয়। হিসাব নিকাশ কিংবা তথ্য উপাত্ত নিয়ে যে বিষয় তাকেই গণিত বলা হয়। গণিতের কাজ হচ্ছে সব ধরনের হিসাব নিকাশ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা। গণিতের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া একটু কঠিন। বিজ্ঞানের যে শাখায় পরিমাণ, গঠন, স্থান এবং পরিবর্তন বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা হয় তাকেই গণিত বলে। আর গণিত নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের গনিতবিদ বলে।
গ্রিক পন্ডিত অ্যারিস্টোটলের মতে ” গণিত হল পরিমাণের বিজ্ঞান।আবার জার্মান গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস এর মতে, ”গণিত হল সকল বিজ্ঞানের রাণী। গণিত বিজ্ঞানের ভাষা। এটি হলো গণিতের সার্বজনীন ভাষা। এ ভাষা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বা গণিতবিদগণ একে অপরের সাথে মতামত বিনিময় করে থাকেন।
গণিতের সূচনা হয় প্রায় ৫৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বর্তমানে ইরাকের দক্ষিণ অংশ তৎকালীন সময়ে মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত ছিল। মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দা ছিল সুমেরীয়রা। তারা ছিল পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত ও শহরে বসবাসকারী মানবসম্প্রদায়। দৈনন্দিন কেনা-বেচার প্রয়োজনে সেখানে গণনা করার রীতি প্রচলিত হয়। তারা এক ধরনের মাটির তৈরি টোকেন ব্যবহার করা শুরু করে এবং প্রতিটি টোকেন দ্বারা একটি অঙ্ক বোঝানো হতো। শহরে নাগরিকদের কর, রাজস্ব আদায়ের হিসাব-নিকাশ, পণ্যদ্রব্যের হিসাব, পশু গণনা ইত্যাদি কাজে এগুলো ব্যবহার করা হতো।
এভাবে প্রায় এক হাজার বছর পেরিয়ে যায়। নতুন সা¤্রাজ্যের বিকাশ ঘটে আর সুমেরীয়দের অর্জিত জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে পরে আরবের আরেক বিখ্যাত ভূখন্ডে বর্তমানে মিশর নামে পরিচিত। মিশরীয়রা গণিত ভালবাসত। হিসাব ও পরিমাপকে অপরের কাছে প্রকাশ করার জন্য তারা বিভিন্ন চিত্রলিপি যেমন বস্তু ও প্রাণীর প্রতিমূর্তি ব্যবহার করত, যার কিছু নমুনা মিসরিয়ান হায়ারোগিøপে পাওয়া যায়।
এভাবে কয়েক হাজার বছর কাটল। গ্রিসের মানুষ তখন গণনা করতে শেখেনি। গ্রিস থেকে এক বিদ্যানুরাগী মিশরে আসলেন অধ্যয়ন করতে। বিদ্যানুরাগী সেই ব্যক্তিটি হলেন পিথাগোরাস। তিনি গণিতকে ভালবাসতে থাকেন এবং মিশরীয়দের প্রযুক্তি জ্ঞান দেখে অভিভূত হন। পরে তিনি নিজ দেশ গ্রিসে ফিরে এসে গণিত শিক্ষার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
পিথাগোরাসের মৃত্যুর ২০০ বছর পর গ্রিসে জন্ম হয় আর্কিমিডিসের। তাকে প্রাচীন যুগের সেরা গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ৭৫ বছর বয়সে আর্কিমিডিসের এক রোমান সৈন্যের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। আর্কিমিডিসের মৃত্যুর পর ক্ষমতালোভী রোমানরা বহু শতাব্দী জুড়ে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার একটি বড় অংশে সা¤্রাজ্য বিস্তার ঘটায়।
গ্রিকদের উদ্ভাবিত গাণিতিক পন্থাকে রোমানরা পুরোদমে ব্যবহার করে গাণিতিক সফলতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। রোমানদের ব্যবহৃত রোমান সংখ্যার প্রচলন আজও আছে। এত সহ¯্র বছর পেরিয়ে গেলেও একটি সংখ্যা শূন্য এর ব্যবহার জানত না।
প্রাচীন মিশরীয়রা শূন্যকে কেবলমাত্র একটি প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করত। প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদ শূন্যকে সংখ্যা হিসাবে প্রথম ব্যবহার করেন এবং বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আনুমানিক ৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে একজন ভারতীয় বার্তাবাহকের ইরাকে আগমনের মধ্যে দিয়ে আরবের মানুষ শূন্যের সংগে পরিচিত লাভ করে। দূর – দুরান্ত এমনকি চীন, ভারত উপমহাদেশ থেকে প্রচুর ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী বাগদাদে পাড়ি জমান। তাদের মধ্যে একজন আধুনিক বীজগণিতের জনক আল খোয়ারিজমি। তিনি সর্বপ্রথম গুণ, ভাগ করার সহজ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন যেটাকে আমরা অ্যালগরিদম বলি।
ব্যবসা – বাণিজ্যের সুবাদে আরবীয় বণিকদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার সম্পর্কে উত্তর আফ্রিকার বণিকেরা অবগত হন। তারাও ভারতীয়দের আবিস্কৃত সংখ্যা পদ্ধতিকে নিজেদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১১০০ সালের শেষের দিকে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ার ফিবোনাচ্চি নামে এক তরুণ গণিতবিদের প্রচেষ্টায় ইউরোপে শূন্যের ব্যবহার ছড়িয়ে পরে। তিনি জন্মসূত্রে ইতালির নাগরিক হলেও বাবার সঙ্গে ব্যবসার সুবাদে আলজেরিয়াতে এসেছিলেন। তিনি ১২০০ সালে নিজ দেশ ইতালিতে ফিরে লিবার আবাচি (খরনবৎ অনধপর), ইংরেজি নাম ঞযব ইড়ড়শ ড়ভ ঈধষপঁষধঃরড়হ, যেখানে তিনি সর্ব প্রখম আল খোয়ারিজমির উদ্ভাবিত বীজ গাণিতিক ধারণাকে ইউরোপিয়ানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মধ্যযুগে তিনি প্রধান গণিতবিদ, যার বীজগণিত, সংখ্যা তত্ত¡, পাটিগণিত ও জ্যামিতিতে অবদান রয়েছে। এরপর মানবসভ্যতাকে আর পিছিয়ে তাকাতে হয়নি। সপ্তদশ শতকে আইজাক নিউটন ও গটফ্রিড ভিলহেল্ম লাইবনিৎস ক্যালকুলাস উদ্ভাবন করেন। গণিতবিদেরা বিভিনান সমস্যার উপর ক্যালকুলাস প্রয়োগ করেনএবং গণিতের নতুন নতুন শাখারও উদ্ভাবন করেন।
বিংশ শতাব্দীতে গণিতের ক্ষেত্রে গবেষণায় জোয়ার আসে। অন্যদিকে হিলবার্ট বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গণিতের ২৩টি সমস্যা প্রস্তাব করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে গণিতবিদরা এই সমস্যাগুলির সমাধানে ব্যস্ত থাকবেন। কিন্তু কিছু সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। যেমন – মৌলিক সংখ্যা সম্পর্কিত রিমান অনুকল্প। হিলবার্টের রেখে যাওয়া সমস্যা এবং আরও নতুন কিছু সমস্যা নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লে ম্যাথমেটিক্স ২০০০ সালে গণিতের এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য মিলেনিয়াম পুরস্কারের ঘোষণা করেছে। ঘোষণাকৃত ৭টি সমস্যার যে কোন একটি সমাধান করলে একজন গণিতবিদ ১ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার পাবেন।
বিজ্ঞানের কয়েকটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও গণিতের জন্য কোনো নোবেল পুরস্কার নাই। ১৯৩৬ সাল থেকে গণিতের সবচেয়ে মর্যদাপূর্ণ পুরস্কার ”ফিল্ডস মেডেল বা ফিল্ডস পদক” নামে পরিচিত। গণিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতি চার বছর পরপর চারজন ব্যক্তিকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এছ্াড়াও ১৯৭৮ সালে ইসরাইলে উলফ ফাউন্ডেশন (ডড়ষভ ঋড়ঁহফধঃরড়হ) প্রতিষ্ঠিত হয়। গণিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতি বছর এই ফাউন্ডেশন পুরস্কার প্রদান করে থাকে।