ডিজিটাল মার্কেটার হতে চাইলে যা যা করণীয়
ব্যবসায় সাফল্য লাভের মূল একটি মন্ত্র হলো ঠিকভাবে ব্যবসার প্রচারণা করা। কথায় আছে না, প্রচারেই প্রসার। ব্যবসার প্রসার তখনই হবে যখন এর প্রচারণা ঠিকমতো হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের শুরু থেকেই প্রচারণার ব্যাপারটি সাথে জড়িত আছে। তবে আধুনিকতার জুগে এই প্রচারণার ব্যবস্থাটিও হয়ে উঠেছে আধুনিক। আধুনিক তো হতেই হবে। পুরনো জিনিস জনসাধারণ আর কতো দেখবে? প্রচারণার এই আধুনিকতার নাম হলো ডিজিটাল মার্কেটিং।
এর মানে হলো যোগাযোগ মাধ্যমের সকল প্রকার আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে কোনো পণ্য বা সেবার প্রচারণা চালানো। এখানে আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা ডিসপ্লে আছে এমন যেকোনো কিছুই অন্তর্ভুক্ত। ডিজিটাল মার্কেটিং এর অনেক ধরণ ও প্রকারভেদ রয়েছে এবং তা নির্ভর করে কোন ধরণের প্রচারণার জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। উপরের কথা মতো যে কেবল ব্যবসার প্রসারের জন্যই মার্কেটিং করতে হয় তা কিন্তু না।
এই ২০১৯ সালে যেকোনো ধরণের সেবা প্রদান কিংবা নতুন কিছু শুরু করার জন্য চাই এর ভালোমতো প্রচারণা করা। হোক সেটি কোনো অনুষ্ঠান কিংবা প্রতিযোগিতার প্রচারণা অথবা কোনো নির্বাচনী প্রচারণা। আর যেহেতু সময়টি এখন ডিজিটাল, তাই প্রচারণার মাধ্যমটিও হওয়া চাই ডিজিটাল। আমরা টেলিভিশনে যতো অ্যাড দেখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে যতো অ্যাড দেখি, মোবাইলে গেইম খেলার সময় যতো অ্যাড দেখি তার সবই ডিজিটাল মার্কেটিং এর আওতাভুক্ত।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর ধারণাটিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য একজন মার্কেটারকে অবশ্যই বেশ কিছু ব্যাপারে দক্ষ হতে হবে। তার আগে ডিজিটাল মার্কেটিং এর পূর্বসূরি অ্যানালগ মার্কেটিং এর ব্যাপারে একটু জেনে নেই। ডিজিটাল মার্কেটিং এ আমরা ঘরে বসেই নতুন কোনো পণ্যের ব্যাপারে বা কোনো সংগঠনের ব্যাপারে জানতে পারছি। কিন্তু অ্যানালগ মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ততো সহজ ছিলো না। বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালানোর বদলে তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচারণা চালাতে হতো। বর্তমানে নির্বাচনের সময় যেমন আমরা দেখি প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোট চাচ্ছে ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
এখানে প্রার্থীরা নিজে উপস্থিত থেকে তার সংগঠনের ব্যাপারে সবাইকে জানান দেয়। এখানে তারা চায় ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্কটাকে গড়ে তুলতে। অ্যানালগ মার্কেটিং এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। ডিজিটাল মার্কেটিং এর জন্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে দিলেই একসাথে কয়েক হাজার কিংবা কয়েক লাখ মানুষ জেনে যাচ্ছে। কিন্তু অ্যানালগ মার্কেটিং এ এক জনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে সেই একজনের মাধ্যমে আরো ১০ জনের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য এখানে ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক ধরে নিজের প্রচারণার জন্য একটি কার্ড বা লিফলেট সবাইকে দেয়া হয়, যেখানে ব্যক্তির পরিচয় এবং তার ঠিকানা দেয়া থাকে। নতুন কোনো সিনেমা বের হলে দেখা যায় এলাকায় এলাকায় পোস্টারিং করা হচ্ছে এবং খবরের কাগজেও এর পোস্টার ছাপা হচ্ছে। এগুলো সবই অ্যানালগ মার্কেটিং এর আওতাভুক্ত।
মার্কেটিং এর জন্য ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ –
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ডিজিটাল মার্কেটিং এসে কি অ্যানালগ মার্কেটিং কে সরিয়ে দিয়েছে? উত্তর হলো, না। ডিজিটাল মার্কেটিং এসে অ্যানালগ মার্কেটিং এর কাজটি আরও সহজ করে দিয়েছে। আগে যেখানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিজের প্রচারণা চালাতে হতো কিংবা লোকজনের কাছে নিজের পরিচয়ের একটি কার্ড বিলি করতে হতো প্রচারণার জন্য, সেখানে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো একটি পোস্ট কিংবা কোনো প্রকার অ্যাডভার্টাইজম্যান্টের মাধ্যমেই নিজের পরিচয় জানান দেয়া যায়।
বাংলাদেশে এখনও অনেক জায়গায় সাধারণ বিলবোর্ডের মাধ্যমে মার্কেটিং করতে দেখা যায়। এটি কিন্তু এক প্রকার অ্যানালগ মার্কেটিং। কিন্তু নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে কিংবা জাপানের টোকিও শহরে তো বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি। এতো আধুনিক দেশ কিন্তু এতো পুরনো পদ্ধতিতে মার্কেটিং করছে কেনো? আসলে তাদের সবকটি বিলবোর্ডে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া। তারা তাদের প্রায় সবকটি বিলবোর্ডে ডিসপ্লে স্ক্রিন ব্যবহার করে। মার্কেটিং সফল হওয়ার পিছনে মূলমন্ত্র হলো তুমি দর্শককে কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারছেন। তোমার অ্যাডভার্টাইজিং যতো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হবে, দর্শক ততো বেশি আকৃষ্ট হবে।
এখন কথা হলো ডিজিটাল মার্কেটিং কি আমরা সবজায়গায় করে বেড়াবো? উত্তর হলো, সব প্রযুক্তি হাতে থাকলেই কি তা ব্যবহার করতে হবে? আগেই বলেছি মার্কেটিং এর মূল উদ্দেশ্য হল দর্শককে আকৃষ্ট করা। দর্শকের চোখ যদি একবার তোমার অ্যাডের দিকে ঘুরানো যায়, তাহলে তুমি কী লিখেছ তা সে পড়ে দেখবেই। ধরো তুমি মরুভূমির মাঝে কোনো এক রাস্তার পাশে একটি বিলবোর্ড বসিয়ে তোমার কোম্পানির প্রচারণা করতে চাচ্ছো। এখন মরুভূমিতে মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কি তুমি ডিসপ্লে বিলবোর্ড বসাবে? মরুভূমির রাস্তা দিয়ে যারা চলে তারা আশেপাশে মরুভূমি ছাড়া আর তেমন কিছুই লক্ষ্য করে না। তাই তুমি যদি খুবই সাধারণ ধরণের একটি বিলবোর্ড বসিয়ে দাও, তাহলে সেটিও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে মার্কেটিং বলতে যে তা ডিজিটালই হওয়া লাগবে এমন কোনো কথা নেই। অবস্থান ও পরিস্থিতি ভেদে তা পুরাতন নিয়মেও কার্যকরী করে তোলা যায়।
এবার এক নজরে দেখে নেয়া যাক ডিজিটাল মার্কেটিং কতো প্রকারের হতে পারে এবং সেগুলোর ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (SEO)
ধরো তুমি একটি অনলাইন বইয়ের দোকান চালু করতে চাচ্ছো। মানুষজন বই অর্ডার করলে তোমার দোকান থেকে সেটি হোম ডেলিভারি দেয়া হবে। এখন কেউ তোমার দোকানের ব্যাপারে জানে না। কারো যদি অনলাইনে বই কিনার দরকার পরে, তখন সে গুগল মামাকে জিজ্ঞাসা করবে “Online Book Shops in Bangladesh”। গুগল মামাও সুন্দর মতো বর্তমান বুকশপগুলোর ব্যাপারে তাকে বলে দিবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ভদ্রলোক সেই শপগুলোর ব্যাপারেই জানবে যেগুলো গুগলের প্রথম পেইজে আছে।
নতুন দোকানের মালিক হিসেবে গুগল তোমাকে চিনতে নাও পারে। তাই গুগল হয়তো তোমাকে প্রথম পেইজে দেখালো না। এখন SEO হলো এমন জিনিস যা গুগলকে বাধ্য করবে তোমাকে সার্চের প্রথম পেইজে নিয়ে আসতে। এজন্য ওয়েব সাইট ডেভলপ করার সময় বেশ কিছু কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করতে হয়। আবার গুগলকে পে করলে সে নিজেই তোমাকে প্রথম পেইজে নিয়ে আসবে। সেটিকে আবার বলে SEM বা সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং। এছাড়াও SEO এর ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে গেলে অনেক মজার মজার তথ্য পাবে।
কন্টেন্ট মার্কেটিং
এখন প্রায়ই দেখা যায় যে, বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো অনলাইন পত্রিকায় কিংবা ব্লগ সাইটে প্রোমোশনাল ব্লগ লেখা হচ্ছে। সেই ব্লগ পড়ে মানুষজন সেই প্রতিষ্ঠানে কী রকম সেবা দেয় তা জানতে পারছে। এগুলো হলো কন্টেন্ট মার্কেটিং। মার্কেটিং এর জগতে নিজের ঢোল নিজে পিটানো তো লাগবেই, সেই সাথে অন্যদের হাতেও ঢোল দিতে হবে একটু পিটিয়ে দেয়ার জন্য। নিজের প্রতিষ্ঠানের সেবার ব্যাপারে মানুষজনকে জানানোর জন্য এরকম মার্কেটিং এখন বেশ কার্যকরী। নিজে লিখতে না পারলে কোনো পেশাদারী ব্লগ লেখককে দিয়েও নিজেদের ব্যাপারে কন্টেন্ট লিখিয়ে নেয়া যায়।
সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
বড় রকমের সম্ভাবনা আছে যে, তুমি এই লেখার লিঙ্কটি প্রথম দেখেছ ফেইসবুকে টেন মিনিট স্কুলের ব্লগ পেইজে। কারণ দিনের একটা বড় অংশ তুমি, আমি এবং অন্য সকলেই সোশ্যাল মিডিয়াতে কাটিয়ে দেই। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমান সমাজে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে, তাই ডিজিটাল মার্কেটিং এর জন্য এটি একটি বড় মঞ্চ সকলের কাছে। কোনো ইভেন্ট কিংবা কোনো পণ্য বিক্রির প্রচারণার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া এখন সকলেই ব্যবহার করছে। এছাড়াও দেখা যায় কোনো ইভেন্টের প্রচারণার জন্য অনেকে এখন প্রোফাইল পিকচারে ফিল্টার হিসেবে ফ্রেম ব্যবহার করে। এগুলোর মাধ্যমেও ইভেন্টের মার্কেটিং করা যায়। পোস্ট শেয়ারিং এবং বুস্টিং এর মাধ্যমে সহজেই মানুষের দ্বারে দ্বারে তোমার প্রচারণা চালাতে পারো।
ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ ধরণের মার্কেটিং। ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এর মূল বিষয় হলো, জনসাধারণের কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয় এমন কাউকে দিয়ে পণ্যের প্রচারণা চালানো। হতে পারে তিনি কোনো বিখ্যাত খেলোয়াড়, সেরা কোনো অভিনেতা কিংবা জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী। মূল কথা হলো এমন কাউকে দিয়ে প্রচারণা করা যার কথা সবাই শুনে এবং বিশ্বাস করে। তখন অনেকের মনে এই ধারণা জন্ম নেয় যে, “আমার প্রিয় তারকা এই পণ্যটি ব্যবহার করে। তাহলে আমিও এই পণ্যই কিনবো।” মূলত এই ধরণের মানসিকতা তৈরি লক্ষ্যই হলো ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং।
ডিসপ্লে অ্যাডভার্টাইজিং
সহজ কথায় এটি হলো বিলবোর্ডের আপগ্রেডেড ভার্সন। আগে বিলবোর্ডে একটি বিশাল বড় ব্যানার টাঙিয়ে প্রচারণা চালানো হতো। আর এখন তা করা হয় ডিজিটাল বিলবোর্ডের মাধ্যমে। বিশাল বড় একটি পর্দায় চাইলে একই সাথে একাধিক পণ্যের প্রচারণা চালানো যায়। বড় বড় শপিং মলগুলোতে এধরণের প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। ঢাকা সহ এখন প্রায় সব শহরেই পুরনো বিলবোর্ডের বদলে আধুনিক ডিসপ্লে বিলবোর্ড জায়গা করে নিচ্ছে। দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় সহজেই এটির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা যায়।
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং
এটি অনেকটা ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এর অনুরূপ। তবে এখানে জনসাধারণের পরিচিত মুখ থাকাটা তেমন জরুরি না। ধরো তোমার একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। সেখানে তুমি যা কিছু করো না কেনো, তার জন্য সবসময় নির্দিষ্ট একটি ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহারের কথা উল্লেখ করো। তোমার যদি একটি রান্নার চ্যানেল থাকে, তাহলে সেখানে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য সামগ্রীর ব্যাপারে সবাইকে বলতে পারো। এর বিনিময়ে সেই ব্র্যান্ড তোমাকে একটি সম্মানি প্রদান করে থাকে। এখানে তুমি সেই ব্র্যান্ডের অ্যাফিলিয়েট হিসেবে কাজ করছো। অর্থাৎ, তুমি তোমার কাজের মাধ্যমে সবাইকে সেই ব্র্যান্ডের ব্যাপারে বলছো। অনেক সময় অ্যাফিলিয়েটদের জন্য আলাদা প্রোমো কোড দেয়া হয়, যার মাধ্যমে ক্রেতারা কোনো পণ্যের উপর বিশেষ ছাড় পেতে পারে।
পে–পার–ক্লিক (PPC)
কোনো লিঙ্কে প্রবেশ করলে দেখা যায় পেইজের উপরে, মাঝে এবং নীচে অনেকগুলো অ্যাড থাকে। এগুলোকে বলে Google AdWords। কেউ যদি এসব অ্যাডে ক্লিক করে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সেই অ্যাডের মালিকের পক্ষ থেকে পেইজের মালিককে দেয়া হয়। এটির মাধ্যমেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা চালানো যায়। এক পক্ষের আয় হলো এবং অন্য পক্ষের প্রচারণা হলো।
ভিডিও গেইমস
অনেকেই পড়ে অবাক হতে পারে যে, ভিডিও গেইমস কীভাবে ডিজিটাল মার্কেটিং এর অংশ হতে পারে! যদি একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো, তাহলে খেয়াল করে দেখবে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আজকাল আলাদা গেইমিং জোন থাকে। মানুষজন সে সব রেস্টুরেন্টে যায় গেইম খেলার আশায়। সেই সাথে সেখানে কিছু খেয়েও আসে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রচারণার জন্য ভিডিও গেইমের আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলগুলোতে এগুলো বেশ লক্ষ্য করা যায়। তাই আজকাল ভিডিও গেইমসও ডিজিটাল মার্কেটিং এর একটি অংশে পরিণত হয়েছে।