ইতিহাস পিছু টানে
অতীব পরিতাপের বিষয় আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস বা অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের দাসত্বের স্বরূপ ও পরিধি নিয়ে কোন উল্লেখযোগ্য কাজ, গবেষণা হয়নি যদিও এই জনপদে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল এবং আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে তাদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। ১৯ শতকের ঢাকা শহরে দাসত্বের প্রকৃতি, পরিমাণ ও বিস্তৃতি শিল্পীর নিখুঁত তুলির আঁচড়ে বিশদভাবে অঙ্কিত হয়েছে জেমস টেইলরের ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ‘A Sketch of the Topgraphy and Statistics of Dacca’ গবেষণাধর্মী বইটিতে। বাংলাদেশ আর্কাইভের নথির রেকর্ড অনুযায়ী জেমস টেইলর ছিলেন ঢাকাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে একজন শল্য চিকিৎসক। উপমহাদেশে ইংরেজ আগমনের বহু আগে থেকেই এখানে দাসত্ব প্রচলিত ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাসের পাতায় দাসত্বের ছাপ লেগে আছে কারণ ঢাকা ছিল একসময়ের দাস ব্যবসার কেন্দ্র। তখন আরব, পূর্ব আফ্রিকা, পারস্য উপসাগর, মৌরিতাস, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে দাস ব্যবসার সম্পর্ক ছিল। এরপর ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে দাস ব্যবসাকে বৈধতা দেয় এবং নিজেরাও দাস ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়। যেমন গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড দাসপ্রথা বিধি-মোতাবেক বাতিল করার বিরোধিতা করে বলেন, “দাস ব্যবস্থায় মালিক এবং দাস উভয় পক্ষেরই সুবিধা আছে।” এমনকি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং আন্দোলন সংগ্রামের পর দাসপ্রথা বিলোপ আইন ১৮৪৩ “Act-V” পাশের শতবছর পরেও ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপনিবেশে প্রায় ৫লাখ ক্রীতদাস বিদ্যমান ছিল। শাসকশ্রেণী আফ্রিকা থেকে কাফ্রি, হাবশি দাস এনেছিল এই বাংলায় যাদের বেশিরভাগ ছিল যুদ্ধবন্দী, অপহৃত শিশু, আদিবাসী বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। দরিদ্র মানুষ অনেক সময় পেটে ভাতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেকে বেচে দিয়েছিল।
এই বাংলায় সাধারণত দুই ধরণের দাস ছিল যথা কৃষিনির্ভর দাস যারা মালিকের জমিতে কৃষি কাজের সাথে-সাথে পশুপালনের কাজ করত। আরেক শ্রেণির দাস জমিদারের পাহারাদার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ইন্দ্রাণী চ্যাটার্জি তার Gender, Slavery and Law in Colonial India বইতে লিখেছেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কলোনিতে দক্ষ অদক্ষ দুই শ্রেণির দাস ছিল। দাসদের কাজ কী সেটা নির্ভর করত মালিকের সম্পদ, পেশা, সামাজিক মর্যাদার উপর। দাসদের বয়স, লিঙ্গ এবং দক্ষতার উপরও নির্ভর করছে তাদের কাজের ধরণ কেমন হবে। নারীদাস সাধারণত মালিকের বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ, ফসল মাড়াই করা, মালিকের বাড়ির শিশুদের দেখভাল করত। তারা অনেক ক্ষেত্রে মালিকের রক্ষিতা হয়ে থাকত, পতিতালয়ে ঠাই হয়েছে অনেকের। খোজা করা পুরুষ দাস এবং রক্ষিতা তৎকালীন সামন্ত রাজা জমিদারদের মনোরঞ্জন করে, লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করে সমাজে বিভিন্ন ভূমিকা রাখত। কিছু দাসদের আবার নিজস্ব দাস ছিল। দাসদের সংখ্যার পরিমাণ, তাদের দক্ষতা তৎকালীন মালিকদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক এবং মালিকের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত ছিল।
১৮৭০ সাল থেকে ব্রিটেনে দাসপ্রথা
১৮৭০ সাল থেকে ব্রিটেনে দাসপ্রথা বিলোপের জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার জোরালে ঢেউয়ের আঘাত লাগে ভারতের মাটিতেও। আন্দোলনের মুখে ব্রিটেন দাস ব্যবসা থেকে সরে আসলেও তারা দাসপ্রথা ও ব্যবসা বন্ধ না করে বরং স্থানীয়দের দিয়ে পরোক্ষ দাসপ্রথা চালিয়ে যায়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক অফিসারদের স্বীকারোক্তি থেকেই জানা যায় কেউ যদি অত্যাচার না করে দাসদের স্বাধীনতা ও অধিকার দিয়ে দাস রাখতে চায় তাহলে সেক্ষেত্রে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। উপনিবেশের শাসক লর্ড কর্নওয়ালিস পর্তুগিজ বা ফ্রান্সের সেটেলারদের জন্য দাসপ্রথা বিলোপ করলেন না, এটার পিছনেও গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বহির্বিশ্ব এবং স্থানীয়দের দেখানো যে ব্রিটেন দাসপ্রথার সমর্থক নয়, তারা ভারতে গৃহকর্মে দাস ব্যবহার করে না। ব্রিটিশ সরকার রায় দেয় যে দাসদের সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করে যে কেউ দাস রাখতে পারবে। সেক্ষেত্রে দাস চাইলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং রয়েল হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটিশ কলোনির ইতিহাস বিশ্লেষক মরগান ফিন বলছেন যে, দাসপ্রথা বিলুপ্ত না করে দাসপ্রথা থেকে দূরে সরে গিয়ে ব্রিটেন দাসপ্রথার নির্মমতার নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। কারণ দাসপ্রথা বিলুপ্ত না করে দূরে থেকেও ব্রিটেন কার্যত প্রকারান্তরে স্থানীয় দাস মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে।
ডাক্তার জেমস টেইলরের মতে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোর তুলনায় ঢাকা এবং আশেপাশের জেলাগুলোতে দাসত্ব বিস্তৃত পরিসরে বিদ্যমান ছিল কারণ এই অঞ্চলের খরা, বন্যা, নদী-ভাঙনের মত নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত মানুষ অসহায় ও গৃহহীন হয়ে পড়ত প্রতিবছর। সেই সঙ্গে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে একসঙ্গে অনেক মানুষ হারিয়ে ফেলত তাদের জীবিকার শেষ সম্বল, বসতভিটা। ফলে জীবনের তাগিদে তাদেরকে বেছে নিতে হতো স্বেচ্ছা শ্রম যাতে হয়ত জুটত অন্নের সংস্থান। একসময়ের স্বাধীন জীবিকার অধিকারী মানুষগুলো প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় এক নিমিষে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে অনিশ্চয়তার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে পাড়ি জমালো শহরে এবং স্থান হলো রেললাইনের বস্তিতে এবং এই ছিন্নমূল মানুষের নতুন নাম হলো চাকর। তখনকার দিনে হিন্দু পুরুষ চাকরের নাম ছিল ভাণ্ডারী বা ক্রীতদাস আর মুসলমান পুরুষ চাকরের পরিচয় গোলাম বা নফর। নারীদের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম ভেদে দাসী ও বান্দি নামে ডাকা হতো। শহরের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গৃহকর্মের জন্য দাসীবাঁদী ছিল। মুসলিম পরিবারে তারা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি রান্নার কাজে সাহায্য করত কিন্তু হিন্দু বাড়িতে শুধু গৃহস্থালি কাজই তারা করতে পারতো।
Map of Dhaka (1840). Source: ‘A Sketch of the Topgraphy and Statistics of Dacca’ by James Taylor
পুরুষ দাসদের নিয়োগ
পুরুষ দাসদের নিয়োগ করা হতো কৃষি এবং চাষাবাদের যাবতীয় কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজে। লাঙল দিয়ে জমি চাষ, ক্ষেত নিড়ানো, আগাছা পরিষ্কার করা, জমি ঠিক করা, মাছ ধরা, কাঠ কাটা, গবাদিপশুর জন্য ঘাসবিচালি কাটা, পশু লালনপালন করা, ফসল মাড়াই করে গোলা ভর্তি করা ছিল তাদের কাজ। এছাড়াও এঁটো থালাবাসন মাজা, নদী থেকে খাবার পানি আনা, মনিবের জন্য হুক্কা এবং পান সাজানো তাদের অন্যতম কাজ। ভাণ্ডারী বা গোলামের মালিক আশেপাশের ছয় সাতটা দাসীবাঁদীদের সাথে তাদের বিয়ে দিতো যাতে তাদেরকে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিয়ে হলেও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো মালিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বিয়ের খরচাপাতি দাসের মালিকই বহন করত কিন্তু এই সাজানো বিয়েতে নারীদের কোন লাভ ছিল না বরং নারীদের যথাসম্বল জমানো টাকা খরচ করে বিয়ের ব্যয় নির্বাহ করা হতো এবং কিছু অর্থের মালিক হয়ে যেত দাস পুরুষটি।
একজন পুরুষ দাসের সর্বোচ্চ বাজার দর ছিল বর্তমানের হিসেবে ১৫০ রুপি এবং নারী দাসীর দাম ১০০ রুপি। নারী দাসীদের কেনা হতো সাধারণত ছোট বয়সে এবং তাদের নিয়োগ দেয়া হতো মনিবের কন্যা, স্ত্রীর সেবা করার জন্য। আমেরিকার ক্রীতদাসদের থেকে ঢাকার ক্রীতদাসের ভাগ্য মনে হয় একটু প্রসন্ন। দাসদের সাথে মোটামুটি ভালো ব্যবহার করত মনিব যদিও সেটা নির্ভর করত মনিবের মেজাজ মর্জির উপর। নারী দাসীদের কাজ খুব বেশি শ্রমসাধ্য ছিল না বরং শারীরিক পরিশ্রমের কাজের জন্য আলাদা দিন মজুর ভাড়া নিত মনিব, মৌখিক বা শারীরিক আঘাত বা নির্যাতন কমবেশি ছিল। তবুও এখানের ক্রীতদাসরা যথেষ্ট স্বাধীনতা, সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। তারাও মনিবের পরিবারের সাথে খাবার খেতে পারত এমনকি পান তামাকের মত তৎকালীন বিলাস দ্রব্যেও তাদের অধিকার ছিল। অনেক ক্রীতদাসের জন্ম হয়েছিল মনিবের বাড়িতে থেকেই অর্থাৎ জন্মসূত্রেই তারা ছিল দাস কিন্তু তারা মনিবের বাড়িতে তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে পড়ালেখা করতে পারতো।
দাস হিসেবে মানুষ কেনাবেচার প্রচলন আধুনিক সময়ে আর নাই। কিন্তু অতীতে ছিল, এই তো কিছুদিন আগেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষের জীবন দাস হিসেবে হাতবদল ঘটত। পূর্বে জমিজমা সম্পত্তির সাথে দাস বিক্রিও চলত, ছিল জমি এবং দাসের জন্য আলাদা দলিল। বর্তমান অর্থের হিসেবে তখন একজন দাসের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য ছিল মাত্র ১৫০ রুপির কাছাকাছি আর নারী দাসীর মূল্য মাত্র ১০০ রুপি। ভাগ্য ভালো হলে নারীদের স্থান হতো মনিবের অন্দরমহলে কিন্তু এমন সৌভাগ্য তো সবার ভাগ্যে জোটে না। সুতরাং বেশিরভাগ নারীদের স্থান হতো শহরের বেশ্যালয়ে পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য। এই অঞ্চলের দাসদের মানবিক কিছু সুযোগ সুবিধা ছিল যেমন মনিব শারীরিক প্রহার করলে সরকারের কাছে সুরক্ষার জন্য আবেদন করতে পারতো। বিচারকের কাছে নালিশ দিয়ে যারা মুক্ত হয়ে যেতো তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যেমন ময়মনসিংহের কয়েকটি গ্রামে জড়ো হয়ে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করতে থাকে কিছু সদ্য মুক্ত দাস। মুক্ত দাসরাই পরে রায়ত, জমিদার, সামন্ত রাজাদের কেরানি হয়, খাজনা সংগ্রহ করে, পাইক পেয়াদায় পরিণত হয় এবং তারা সমাজে কায়স্থ হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৮৪৩ সালের দাসপ্রথা
১৮৪৩ সালের দাসপ্রথা সংশোধন আইন পাশ হলেও বাংলা থেকে পরিপূর্ণভাবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হতে শতবছর সময় লেগেছে। ১৮৪৩ সালের “Act-V” আইনটি দাসত্ব বিলোপ না করলেও দাস এবং মুক্ত মানুষের মানুষের মধ্যে ব্যবধান দূর করতে সাহায্য করেছিল। আফ্রিকা থেকে নতুন দাস আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও প্রায় ২০শতকের শুরুর দিকে পর্যন্ত স্বল্প পরিসরে দাসত্বের চর্চা সমাজে বিদ্যমান ছিল। হয়ত মাত্র কয়েক প্রজন্ম আগেও আমাদের পূর্ব প্রজন্ম বাধ্য-শ্রমে নিযুক্ত ছিল, কিন্তু আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, ইতিহাসের পাতায়, সাহিত্য সংস্কৃতিতে এমনকি অন্য কোন শিল্প মাধ্যমে সেই অমানবিক নিষ্ঠুরতার কোন উল্লেখ নাই। বাংলার ক্রীতদাসের অতীত কালো অধ্যায়ের সঠিক ইতিহাস পঠন পাঠন এখন সময়ের দাবী, কারণ আমেরিকা, ইউরোপে কিছুদিন আগের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে একদল মানুষ ভেঙে ফেলেছে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড ক্লস্টনের স্ট্যাচু। ব্রিস্টলের মেয়র এই ঘটনাকে ‘দুঃসাহসী’ হিসেবে আখ্যা দেন। আমাদের মুক্ত আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা সন্তানদের স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে বাংলার দাস ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে জানানো উচিৎ কেমন ছিল পূর্ব-প্রজন্মের সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থা। কেউ কেউ বলতে পারে এই বাংলায় দাসপ্রথা সামান্য মাত্রায় বিরাজিত ছিল, তারা সুবিধা বঞ্চিত, তারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিজেদের বেচতে বাধ্য হয়েছিল, তবুও তাদের সন্তানরাও আইনি সুরক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস যাই হোক তার সঠিক এবং নির্মোহ পাঠ যদি আমাদের সন্তানদের নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে জন্ম নেবে শিকড় বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম।
লেখক:
মোঃ আব্দুল্লা-আল-মামুন রুপম
ইন্সট্রাকটর, ইলেকট্রিক্যাল
ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট