থেমে যাবার তো উপায় নেই, চলতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে

থেমে যাবার তো উপায় নেই,

চলতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে

দিনটি ছিলো ফেব্রুয়ারী মাসের শুরুর দিকের কোন একটি দিন। হঠাৎ করেই জরুরী বৈঠকের নোটিশ। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেলাম প্রধান কার্যালয়ে। সবার গুরু গম্ভীর মুখ দেখে বোঝা গেল বিষয়টি হয়তো একটু বেশীই জরুরী। সহকর্মীরা সবাই একে একে যোগ দিলেন বৈঠকে। বৈঠক শুরু হলো। বৈঠকের বিষয় স্পষ্ট হলো সম্ভাব্য করোনার মহামারীতে আমাদের প্রস্তুতি। যেহেতু করোনা শব্দটি তখনও ততোটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি তাই প্রথমেই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান জনাব মোঃ সবুর খান যা বলছিলেন তার সারাংশ হলো সামনে অনেক কঠিন সময় সুতরাং আমাদের নিজস্ব গন্ডির মধ্যে থেকে ক্লাস থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার আমাদের শতভাগ নিশ্চিত করতেই হবে। সম্ভব/অসম্ভবের মধ্যে দোদুল্যমান আমার অবস্থান। একই সাথে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমার সহকর্মীদের মনের অবস্থান এবং আমার মনোভাবের সাথে তাদের মনোভাব মেলাবারও চেষ্টায় ছিলাম। এখন বলতে আপত্তি নেই, আমার কাছে অসম্ভবের পাল্লাই বেশী ভারী ছিল। কোথায় চীন দেশ আর কোথায় আমরা। আমাদের সেই শক্তি কোথায়? যা হোক কোন কিছু না ভেবেই মনে মনে ভাবলাম কিছু একটাতো হবেই। বিসমিল্লাহ বলে সহকর্মীদের সাথে নেমে পড়লাম কাজে। একটা বিষয় খেয়াল করলাম নেতৃত্ব যদি হয় শক্তিশালী এবং সুদূর প্রসারী তাহলে তার প্রভাব কর্মীদের উপর পড়বেই। আমি ভেতর থেকে একধরনের শক্তি অনুভব করলাম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারকেও ধন্যবাদ দিতে হয় বেশ কিছু ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কিছু বাস্তবিক স্বীদ্ধান্ত গ্রহন করবার জন্য।

ফেব্রুয়ারী মাস গড়িয়ে মার্চ চলে এলো। করোনা নামক চক্রে আমরাও পড়তে যাচ্ছি বিষয়টি স্পষ্ট হলো। আগে থেকেই নেয়া স্বীদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ গোছানো হচ্ছিলো। শুরু হলো অনলাইনের যাত্রা। নির্ধারন করা হলো হাতের কাছে থাকা সহজ কিছু প্রযুক্তি যেমন গুগল মিট, জুম, গুগল ক্লাসরুম, মুডল এবং অনুশীলন করা হচ্ছিল তার ব্যবহার। পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে চলেছে চার দেয়ালের ক্লাস রুমে ভার্চুয়াল ক্লাস, পাশাপাশি বসে ভার্চুয়াল মিটিং, ফাইল শেয়ারিং, অনলাইন হাজিরা ইত্যাদি। এক বন্ধু আমার অফিসে এসে দ্যাখে আমি ভার্চুয়াল মিটিং করছি আমার পাশের রুমে থাকা সহকর্মীর সাথে। ও কিছু না বলে ভ্রু কুচকে চায়ের কাপে চুমুক ‍দিচ্ছিলো। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো লকডাউন। মাথায় সারাদিন দুটি শব্দই ঘুরপাক খেতে লাগলো করোনা এবং লকডাউন। বেড়ে গেলো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডের বিশাল দায়িত্ব আমাদের সকল সহকর্মীদের উপর। শক্তি ছিলো নেতৃত্বের আর এতোদিনের আত্মবিশ্বাসের। চিন্তা করলাম একটা কিছুতো হবেই।

শুরু হলো লকডাউনের মধ্যেই প্রতিদিন রুটিন মাফিক অনলাইন ক্লাস, মিটিং, পরীক্ষা, কুইজ, অভিভাবক সম্মেলন, অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। অবাক হলাম যাদের নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশী চিন্তিত ছিলাম আমাদের সেই কোমলমতী ছাত্রছাত্রী যারা লকডাউনের কারনে ফিরে গিয়েছিলো গ্রামে তাদের উৎসাহ এবং সতস্ফুর্ত অংশগ্রহন দেখে। শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের কাছে থাকা সীমিত ইন্টারনেট এবং ডিভাইস ব্যবহার করে যুক্ত হচ্ছিলো অনলাইন ক্লাসে। রাতদিন চলেছে বিরতিহীন ক্লাস ও অনলাইনে পড়াশুনার কার্যক্রম। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। মনে মনে ভাবতাম আরে উন্নত বিশ্ব তাহলে এভাবেই আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। একটা সময় দেখলাম ছাত্রছাত্রীতো বটেই বাবা-মা সবাই অংশগ্রহন করছে অনলাইন ক্লাসে। পেছনে ফিরে তাকানোর সময় হয়নি। করোনা তার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। আমরাও সবাই সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছি। সমস্যাতো আসবেই। থমকে যাবার অবকাশ নেই। হঠাৎ মনে হলো কর্মের সঠিক পরিসংখ্যান দরকার। ফলাফল যা বের হলো তাতে আমিও কিছুটা অবাক হলাম। ড্যাফোডিল পরিবারের স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে

  • লকডাউনের প্রথম ৯০ দিনে প্রায় ৬০ হাজার ক্লাস সম্পন্ন হয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে
  • গড়ে প্রতি ক্লাসে উপস্থিতি ছিলো ৬৮%
  • এই হিসেবে ড্যাফোডিল পরিবারের ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রতিদিন ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিয়েছে।
  • অভিভাবক সম্মেলন হয়েছে প্রায় ৫০টিরও বেশী
  • অনলাইনেই সম্পন্ন হয়ে কুইজ, ক্লাস টেষ্ট, পরীক্ষা, এ্যাসাইমেন্ট,
  • দেশ-বিদেশের বিখ্যাত প্রফেশনালদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০ অধিক ওয়েবইনার।
  • প্রায় ৩০০ সহকর্মী মিলে যার যার ঘরে অবস্থান করে আমরা আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছি তিনটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট (হেকাথনের আদলে করোনাথন, অনলাইন লার্নিংকে সবার মাঝে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য অনলাইন লার্নিং সামিট এবং ঘরে বসে মেধাভিত্তিক কাজ করা সম্ভব এই সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরে তরুনদের চাকরির সুযোগ তৈরি করবার জন্য আয়োজন করা হলো ভার্চুয়াল জব ফেস্ট)। এই তিনটি ইভেন্টে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের আরো প্রায় ২০টি দেশের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়।
  • সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমরা প্রায় ৩০০০ সহকর্মীরা একে অপরের সাথে মিলে গত ৯০ দিন কাজ দিলাম, কাজ করলাম কিন্তু কারো সাথে সরাসরি দেখা হলো। সবাই যার যার ঘরে বসে যার যার কাজ সম্পাদন করলাম। এটাই একসময় অসম্ভব ছিলো যা বর্তমানে বাস্তব।

এতো বিশাল কর্মযজ্ঞের মাঝে হঠাৎ ড্যাফোডিল পরিবারের মনে হলো কেননা আমরা এমন একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করি যার মাধ্যমে অন্যরাও অনায়সে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সূচনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য Blended Learning Center, কলেজ-পলিটেকনিকের জন্য college.ac এবং স্কুলের জন্য schoolbd.ac । এই প্ল্যাটফলমগুলো বাংলাদেশের যেকোন স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক, বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহার করতে পারবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

আসলে পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের যেকোন পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাবার এক বিরাট ক্ষমতা দিয়েছেন। আমরা তা বুঝি না। একটা সময় যা ছিলো অসম্ভব তা এখন বাস্তব। সামনের পৃথিবী হয়তো আরো অজানা, দুর্বোধ্য। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তার সেই শক্তিশালী উপমার উপর “মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা”। সুতরাং থেমে যাবার তো উপায় নেই। চলতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে।

—————————————– X ——————————————

লেখকঃ-

কে এম হাসান রিপন

নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট

Comments are closed.