আছি জ্ঞানের ঋণে, শোধ করিবো কত দিনে?
গরম ধূমায়িত এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে সকালের ঝুম বৃষ্টির ফোটা গুলো দেখছিলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্রতিটি ফোটা কাছের পুকুরটিতে হুমরি খেয়ে পরছিলো। প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখে আমি যখন অনেকটা আত্বিক কবি সেই মুহুর্তে পাশে ফ্লাটের আনোয়ার ভাইকে দেখলাম একটা ছাতা মাথায় দিয়ে হাটু পর্যন্ত প্যান্ট উচিয়ে অনেকটা ব্যাস্ততার সাথেই বের হলেন। স্বাভাবিকতা মেনেই বললাম এতো সকাল সকাল কোথায় চললেন? আনোয়ার ভাই এক গাল হাসি টেনে বললো “ ভাই আজ ব্যাংকের লোনের টাকার কিস্তি দেয়ার শেষ তারিখ, লম্বা লাইনের চক্করে না পরতেই এতো সকালে বের হওয়ায় এই আয়োজন।“ উনার ব্যস্ততা দেখে আর কথা বাড়ালাম না।
টেবিলের উপর রেখে দেয়া বইটি নিয়ে ক্লাসের পড়া এগিয়ে নিতে পড়তে শুরু করলাম। বেশ কয়েকটা অনুচ্ছেদ পড়ার পর হঠাত আনোয়ার ভাইয়ের সকালের কথাটি মনে পরলো। একজন সুস্থ মানুষ সর্বোদা সচেষ্ট থাকে তার পাওনাদারের সম্পদ যথা সময়ে ফেরত দিতে। আনোয়ার ভাইও সেরকমই একজন মানুষ বিধায় উনি সময় মত ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য সকাল সকাল বৃষ্টির মধ্যেও বের হয়েছেন। কিন্তু আমার মতে একজন মানুষকি সুধুই অর্থিক ভাবেই ঋণী হলে তা ফেরত দিতে এতো সচেষ্ট হবে নাকি আরো কিছুর জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত? আমরা কি সবাই প্রত্যেকে ঋণ মুক্ত নাকি ঋণী? একবার আমার এক বন্ধু খুব গর্ব করেই বলেছিলো সে এবং তার পরিবার কোন দিন কখনো কারো নিকট হতে ধার নেয়না অর্থাৎ ঋণ করেনা। এটা তাদের বংশ গত শিক্ষা সে বলছিলো। যাইহোক তার সেই দাম্ভিকতা সেদিন আমার মত অনেকেই হজম করে শুনছিলাম। কিন্তু আজ মনের মাঝেই বলে উঠছে আমরা সবাই ঋণী। এই ঋণ আমরা কেউ শোধ করতে সক্ষম হয়েছি আবার কেউ এই ঋণ শোধের চেষ্টায় আছি আবার কেউ এই ঋণ শোধের পর অন্যদের ঋণ দিচ্ছি। কিন্তু তবুও এই ঋণ কোন দিনই শোধ করা সম্ভব না। কিসের ঋণ বুঝেননি তাইতো? মনের গভির থেকে একবার ভাবুন তো আপনি আমি জ্ঞানের ঋণ করছি কি না? সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সামাজের প্রতি ঋণ অনেক বড় একটা বিষয় আর এই বড় বিষয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ হলো জ্ঞাণের প্রতি ঋণ। জ্ঞানের প্রতি ঋণ শুনতে কেমন জানি লাগছে তাইনা? অনেকেই হয়তো বলছেন এ কেমন ঋণ যার ভিত্তি এখনো বুঝলাম না। আচ্ছা আমাকে বিষয় টা পরিষ্কার করতে দেন।
এইযে, আপনি আমি ক্লাসের বই বলুন আর গল্পের বই বলুন কিংবা মাল্টিমিডিয়ার তথ্য নির্ভর যেকোন কিছুই বলুন সবই কিন্তু কোন না কোন ব্যাক্তি দ্বারা লিখা বা তৈরিকৃত। এমনকি এই যে আমার পোস্ট টি পড়ছেন এটাও। আপনি জানেন কি এগুলো ধার করা জ্ঞান আপনার আমার জন্য? সেই সব লেখক, উদ্ভাবক, কারিগর দিনের পর দিন জ্ঞান সাধণা করে লিখে গেছেন এক একটি তথ্যবহুল বই। এই বই এর শিক্ষা গুলো তাদের পরিশ্রমের জ্ঞানের। যার মূল্য আপনার আমার বই এর শুরুতে লিখা টাকার অংকে করা নেহাত বোকামি মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই না। আমরা তাদের জ্ঞান ধার করে পড়ছি বছরের পর বছর। শুধুই যে ক্লাসের বই তাই নয়, বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞান, গল্প উপন্যাস, কবিতা প্রবন্ধ ইত্যাদি সব কিছুই। এখন কেউ হয়তো বলবেন তাহলে কি এগুলো জ্ঞান ধার করা আমাদের জন্য উচিত নয়? আমরা কেন জ্ঞান ধার করবো? ধার করা জ্ঞান আমরা আর নিবোনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এহেম! এহেম! ভাই আমরা সামাজিক জীব। এখানে একজন অপরজনের উপর নির্ভরশিল এবং দায়বধ্য। ওই যে বললাম সামাজিক দায়বদ্ধতা। আপনি যত বড়ই ব্যাক্তি হোন না কেন, আপনাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে থেকে একে অপরের সাহায্যে জীবন পরিচালিত করতেই হবে। আর এগুলো সাহায্য নেয়া আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। জীবনের শুরুতে আমরা যেমন বাবা মা এর উপর নির্ভর থাকি খাওয়া, চলা সব কিছুতে আর এর পরে ধাপে-ধাপে শিখে নিই সব কিছু তেমনি রক্ত মাংশের এক প্রানী থেকে মানুষে পরিনত হতে শিক্ষা জীবনের শুরুতে এই মহান লেখক উদ্ভাবক গণের বিতরন করা জ্ঞান ধার/ ঋণ স্বরুপ আমরা গ্রহণ করি। সময়ের সাথে সাথে এই ঋণ এর পরিমানও বেড়েই চলে। এক সময় আপাত দৃষ্টিতে প্রাতিষ্ঠানিক এই শিক্ষা শেষ করে আমরা প্রবেশ করি কর্ম ব্যাস্ত জীবনে। কর্ম জীবন টা এমন এক জীবন যেখানে আপনার সেই সব ধার বা ঋণ করা জ্ঞান কে বাস্তবতায় ইনভেস্ট করতে হয় জীবনকে পরিচালিত করতে। সঠিক ভাবে জ্ঞানকে ইনভেস্ট করতে পারলে আপনি লাভবান হবেন যা আপনার ঋণ গ্রহণের সফলতা হিসেবে ধরা হবে এবং সেই সাথে আপনার এই সফলতার ফল গুলোকে অনেক টা ধার করা জ্ঞান গুলোর শোধ স্বরুপ ধরা যেতেই পারে। কিন্তু শুধু একটা জ্ঞান কি শোধ করলেই হবে? জীবনে কত কত জ্ঞান আপনি ধার করেছেন তার হিসেব নেই।
এবার আরেকটি মজার বিষয়ে আসি। আপনি জ্ঞান ধার করেছিলেন আর তা ইনভেস্ট করে সফলতা পেয়ে মোটামোটি ফেরতও দিলেন। সাধারণত আমরা সুস্থ মানুষেরা তখনই অর্থ বা সম্পদ ধার নিয়ে ফেরত দেই যখন সেই ধার করা অর্থ/ সম্পদের বেশি আয় করা হয় আর তা ফেরত দেয়ার পরেও কিছু থাকে যা ভবিষ্যত জীবন চালাতে অবশ্যই লাগবে। তাহলে জ্ঞানের দিক থেকে যদি হিসেব করি বিষয় টা এমন যে আমি জ্ঞান ইনভেস্ট করে সফলতা পেয়ে এমন কিছু হতে পেরেছি যার ফলে আমি মোটামোটি সেই বিষয়ে ধার করা জ্ঞান শোধ করেছি আর বাকি সামনের ভবিষ্যত জীবন এই সফল হওয়ার অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অবশ্যই চলতে হবে। এখন হিসেব করে দেখুন যে, আপনি বা আমি ধার করে জ্ঞান নিয়ে ইনভেস্ট করে সফল হয়ে সেই সফল হওয়ার অর্জিত ফল কে কাজে লাগিয়ে সামনের ভবিষ্যত কাটিয়ে দিলেও একটা জিনিস শূণ্য থেকেই যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে সেই পর্যায়ের জ্ঞান যা আমি অন্যকে ধার/ ঋণ দেয়ার কথা যা সেই সকল লেখক উদ্ভাবক গণ করে গেছেন। তারাও জ্ঞান ধার করেছেন, ইনভেস্ট করেছেন, সফলতা পেয়েছেন আর শুধু নিজের ভবিষ্যত চলার মত করেই চলে গেছেন তা নয়। তারা তাদের পরিশ্রম করা অর্জিত জ্ঞান গুলোকে নিজের বাকি জীবন চলার পরেও আরো যে জ্ঞান অর্জন করে গিয়েছেন তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছেন লিখে বা উদ্ভাবনের মাধ্যমে। অনেকেই তো সফল হয়, আদর্শ স্বরুপ মানুষও হয়ে উঠে কিন্তু কয়জন রয়েছে যারা তাদের সেই অর্জিত জ্ঞান মানব জাতির কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন? জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান দান অনেক পার্থক্য রাখে। জ্ঞান যে কেউ অর্জন করার অধিকার বা ক্ষমতা রাখে কিন্তু জ্ঞান দান করার যোগ্যতা সবার থাকেনা। যে আপনিই একদিন জ্ঞান ধার করে চলেছিলেন সেই আপনিই সবার মাঝে জ্ঞান দান করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এমন মহৎ হৃদয় কয় জনের হয়? আমরা আজও জ্ঞান ধার করে চলেছি কিংবা কেউ কেউ জ্ঞান ইনভেস্ট করছি আবার এমনও অনেকে আছি যারা জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি কিন্তু জ্ঞান দান করে সামাজিক যে দায়বদ্ধতা তা কয় জনে শোধ করেছি? জানি সামাজিক ঋণ কিংবা জ্ঞানের ঋণ কোন দিনই সম্পুর্ন শোধ সম্ভব নয়, তবুও তো সাধ্যমত যার যত টুকু আছে তা দিয়ে তো জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে পারি একে অন্যকে। আজ আপনার অর্জিত জ্ঞান যদি দান না করেন তাহলে মনে রাখবেন একদিন আপনি মারা যাবেন আর কবর দেয়ার সাথে সাথেই সেই অর্জিত জ্ঞান দান না করায় মাটির সাথে পচে জৈব সার হয়ে যাবে। প্রশ্ন করুন নিজেকে আপনি কতটুকু জ্ঞান অর্জন করলেন আর কত টুকু শোধ করে দান করলেন। তাই তো বলি “ওহে যুবক আছি জ্ঞানের ঋণে, শোধ করিবো কত দিনে?”
—————————————-
এস.এম.রাজিব আহম্মেদ
ইন্সট্রাকটর
ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং