বাংলাদেশেই বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা !!
বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ‘প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড’। পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে ইউএসজিবিসি থেকে প্লামি ফ্যাশনস ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদ পেয়েছে। এ জন্য কারখানার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৮০ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও প্লামি পেয়েছে ৯২ পয়েন্ট। ইউএসজিবিসি হল আমেরিকার গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল । এটি পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ প্রদানকারী একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।
পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে ৫ দশমিক ৫০ একর জমির ওপরে ৫৮ হাজার বর্গফুটের এই কারখানায় সর্বদায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ছিমছাম পরিবেশে কাজ করছেন ১ হাজার ২০০ শ্রমিক।
মাসে ৯ লাখ ২০ হাজার পিস পোশাক উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন এ কারখানাটি শনিবার ২৫ এপ্রিল ২০১৫, উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
কারখানাটিতে তিনটি দোতলা ভবন রয়েছে । যার ছাদ টিন শিট দিয়ে নির্মিত। ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল লাগানো হয়েছে। দুই তলার মূল কারখানা ভবনটি ইস্পাতের (প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং) তৈরি। তিন পাশেই আছে লম্বা বারান্দা। ফটকের পাশেই বাইসাইকেল রাখার ছাউনি। শ্রমিকরা ছাউনিতে তাদের সাইকেল রাখেন।
ওঠা-নামার জন্য পাঁচটি সিঁড়ি থাকলেও বের হওয়ার দরজার সংখ্যা ১১টি। শ্রমিকেরা যাতে স্বস্তিতে কাজ করতে পারেন সে জন্য পুরো কারখানাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সব সময় সেখানে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকবে।
ভবনের ওপরের তলার পুরোটাই সূর্যের আলোয় চলবে। এতে ৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। আবার কোনো কারণে আলোর স্বল্পতা দেখা দিলে আপনাআপনি জ্বলে উঠবে এলইডি বাতি। এ ছাড়া পুরো ভবনে পাইপ লাগানো হয়েছে, যা দিয়ে বৃষ্টির পানি নিচের ট্যাঙ্কে জমা করা হবে। এ জন্য দুই লাখ লিটার ধারণক্ষমতার একাধিক ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। আর এই পানি বাথরুমের পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত হবে। কারখানার ছাদে স্থাপিত সৌরবিদ্যুতের প্যানেলের মাধ্যমে চাহিদার ১৩ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে। সব মিলিয়ে অন্য তৈরি পোশাক কারখানার চেয়ে এখানে বিদ্যুৎ ও পানি অর্ধেক কম লাগবে।
মূল কারখানা ভবনের সামনে রোপণ করা হয়েছে দেশিয় গাছ। সব মিলিয়ে কারখানার চত্বরে আছে ৫২ শতাংশ খোলা জায়গা। এই বিশাল খোলা জায়গা নিয়ে শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার করা হয়েছে। সেন্টারের সামনে আছে ছোট লেক ও ফোয়ারা।
ডাইনিং হল
তিনটি ভবনের একটি ভবন শুধুই শ্রমিকদের জন্য ব্যবহার হবে । দুই তলা এই ভবনের নিচতলায় শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ থাকছে।
ওপরের তলায় আছে নামাজঘর ও একটি প্রশিক্ষণ কক্ষ। এখানে একসঙ্গে ২০০ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে ।
একটা বিনোদনকক্ষ আছে, টেলিভিশন, ক্যারম বোর্ড, লুডু সহ বেশ কিছু খেলার সামগ্রী আছে ক্লাবের মতো ।
চাইল্ড কেয়ার হোম
ফোয়ারার আরেক পাশে আলাদা ভবনে পণ্যের গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৩ হাজার বর্গফুটের এই আধুনিক গুদাম তিন তলাবিশিষ্ট। পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য থাকবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। গুদামের সামনেই কর্মকর্তাদের কার্যালয় ও নিটিং কারখানা। কারখানার পেছনের অংশে করা হয়েছে ডায়িং কারখানা। পাশেই আছে বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি। এ ছাড়া আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। সব ভবন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে কোনোটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে, অন্যটিতে তা ছড়াবে না।
এদিকে কারখানায় বসানো হয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তির সেলাই মেশিন, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি ধুলাবালি শোষণ করে নেবে আপনাআপনি। উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছে যে, পোশাক তৈরি থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সেখানেই মোড়কজাত হয়ে যাবে।
রানা প্লাজা আর তাজরীন ফ্যাশানের মতো দূর্ঘটনার পরে বিদেশি ক্রেতারা এবং দেশি শ্রমিকরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানার পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ তোলে। দুর্ঘটনার পেছনে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ত্রুটিই প্রধান কারণ।
সেদিক থেকে প্লামি ফ্যাশন নমুনাই বটে।
ইউএসজিবিসির সনদ পেতে একটি প্রকল্পকে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়।
প্লামির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হকের দাবি, তারা ইউএসজিবিসির নিয়ম-কানুন শুরু থেকেই মেনে চলছেন। তিনি বলেন, ‘লিড সনদের ১১০ নম্বরের মধ্যে প্লাটিনাম পাওয়ার জন্য দরকার ৮০ নম্বর। আমরা পেয়েছি ৯২। এটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পৃথিবীর প্রথম প্লাটিনাম সার্টিফিকেটধারী কারখানা আমাদের প্লামি ফ্যাশন লিমিটেড।’
তিনি আরো বলেন, ‘লিড প্লাটিনামের শর্ত হচ্ছে এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে, যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। ইট, বালি, সিমেন্ট এগুলো রি-সাইকেলড ‘র’ মেটেরিয়াল হতে হবে। আমরা সেগুলো করেছি। এমনকি সব উপকরণ কারখানার সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করেছি। এতে পরিবহনের জ্বালানি খরচও কম হয়েছে। তাদের শর্ত অনুযায়ী নির্মাণ উপকরণের ৯০ শতাংশই দেশীয় ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া প্লাটিনাম পাওয়ার অন্যতম মূল শর্ত হলো ৫০০ বর্গমিটারের মধ্যে শ্রমিকদের থাকার জায়গা বাসস্থান, স্কুল, বাজার, বাস বা টেম্পো স্ট্যান্ড থাকতে হবে। কারণ দূরে হলেই শ্রমিকদের কারখানায় আসতে গাড়ির প্রয়োজন হবে। এতে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হবে। এ ছাড়া আমাদের রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল-মোট বিদ্যুতের ১৩ শতাংশ আসে এখান থেকে। শ্রমিকদের গুদামে মাথায় করে বস্তা নিতে হবে না, লিফটে করে বস্তা উঠবে, নামানোর সময় স্লাইডে ছেড়ে দেবে।
শ্রমিকের বেতন-ভাতা সম্পর্কে ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের এই এলাকায় যত গার্মেন্ট আছে এবং প্রচলিত যে বেতন কাঠামো রয়েছে, তার চেয়ে বেশি। শ্রমিকদের জন্য ডাইনিং ফ্যাসিলিটি দিয়েছি-যেটা বাংলাদেশের অনেক ফ্যাক্টরিতেই নেই। একটা বিনোদনকক্ষ আছে, টেলিভিশনসহ বেশ কিছু খেলার সামগ্রী থাকবে-মোটকথা ক্লাবের মতো, শ্রমিকরা টিভি দেখবে, ক্যারম বোর্ড খেলবে, লুডু খেলবে।’
শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অন্যান্য পোশাক কারখানা থেকে মাসিক বেতন এ কারখানায় বেশি। এছাড়াও মেডিক্যাল ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে
উল্লেখ্য যে, বিশ্বের পোশাকশিল্পে এখন পর্যন্ত ৪টি কারখানা লিড সনদের প্লাটিনাম মর্যাদা পেয়েছে। এর মধ্যে দুইটি বাংলাদেশরই ‘ভিনটেজ ডেনিম’ ও ‘প্লামি ফ্যাশন্স’ । এবং অপর দুটি শ্রীলঙ্কার ।
References:
http://plummyfashions.com/
http://plummyfashions.com/about-us/
http://textilefocus.com/plummy-fashion-ltd-inspiration-green-industry-world/
https://www.apollo.io/companies/Plummy-Fashions-Ltd/57c4954da6da983260b8032f?chart=count
https://textilelab.blogspot.com/2018/05/blog-post_8.html
https://www.facebook.com/permalink.php?id=102516761556477&story_fbid=129169915557828
http://niterians.blogspot.com/
http://niterians.blogspot.com/search/label/Factory
Writer: K.M. Fahim Istiaque
Instructor, Textile Technology